শুক্রবার , ৩ জানুয়ারি ২০২৫ | ২১শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অপরাধ
  2. অপরাধচিত্র বিশেষ
  3. আইন-আদালত
  4. আন্তর্জাতিক
  5. খুলনা
  6. খেলাধুলা
  7. চট্রগ্রাম
  8. জাতীয়
  9. জেলার খবর
  10. ঢাকা
  11. তথ্য-প্রযুক্তি
  12. প্রবাসের কথা
  13. বরিশাল
  14. বিনোদন
  15. ব্যাবসা-বাণিজ্য

জাপার রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ

প্রতিবেদক
Newsdesk
জানুয়ারি ৩, ২০২৫ ১০:২০ অপরাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক :

১৯৭৯ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বিএনপিতে যুক্ত হয়ে রাজনীতিতে পথচলা শুরু করেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার। ২০২৪ সাল পর্যন্ত থেকেছেন ক্ষমতার কাছাকাছি। দীর্ঘ এই সময়ে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তিনি ও তার স্ত্রী সাবেক সংসদ সদস্য নাসরিন জাহান রত্না আমিন কুয়াকাটা, কলাপাড়া, দুমকি, বেতাগীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কেনা ও দখলিসূত্রে শত শত একর জমির মালিক হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে মামলা-চলা জমির মালিকানা দেখিয়ে ব্যাংক লোন নেওয়ার। কলাপাড়া ও কুয়াকাটা এলাকা ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

স্থানীয়রা জানান, জমির দখল নিতে রুহুল আমিন হাওলাদার পুলিশ, স্থানীয় সংসদ সদস্য, পৌর মেয়র, নিজস্ব পেটোয়া বাহিনীসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও রাজনীতিবিদদের ব্যবহার করেছেন।

জমি দখলে প্রায় অর্ধশত পরিবারকে উচ্ছেদ

হোটেল কুয়াকাটা গ্র্যান্ড অ্যান্ড রিসোর্টের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিগ্রহণ করা দেড় একর জমির ওপর বসবাস করতেন বসন্ত কুমার ও মধু রাখাইনসহ অন্তত অর্ধশত পরিবারের সদস্য। হাওলাদারের লোকজন বসন্ত কুমারকে মেরে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এখন পরিবারটি মহিপুর ইউনিয়নের মম্বিপাড়ায় বসবাস করছে। তাদের আতঙ্ক এখনো কাটেনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেউ কথা বলতে রাজি হননি। একইভাবে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মধু রাখাইনসহ অন্তত অর্ধশত রাখাইন পরিবারকে। হাওলাদারের পেটোয়া বাহিনীর ভয়ে বসতভিটা ছেড়ে তারা মায়ানমারের আরাকান রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছেন বলে জানা গেছে।

জাল দলিলের অনুকূলে এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে ব্যাংকঋণসহ চলমান মামলার দলিল মর্টগেজ দিয়ে ব্যাংক থেকে লোন গ্রহণের অভিযোগ আছে। কুয়াকাটা পৌরসভা এলাকার সাবেক লতাচাপলী মৌজায় মো. সিরাজুল হক ও মো. সেকান্দার আলী সিকদারের ৫ একর ৩২ শতাংশ জমি সিক্স স্টার গ্রুপের কাছ থেকে কেনে রুহুল আমিন হাওলাদারের মালিকানাধীন কেআর ফ্যাশন ইন্টারন্যাশনাল। এই জমিটি জাল দলিলের মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়েছে অভিযোগ এনে ২০০৮ সালে মনির আহমেদ ভূঁইয়া আদালতে একটি মামলা করেন। মামলা নম্বর ৯০/২০০৮। সেই মামলা এখনো চলছে। জাল দলিল ও মামলা চলা অবস্থাতেই ওই জমির বিপরীতে রুহুল আমিন হাওলাদার বেসরকারি একটি ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে প্রায় ৭ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেন।

শহিদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর জমি দখল

মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে বিধবা মানোয়ারা বেগমের নামে ১৯৯৬ সালে বন্দোবস্ত দেওয়া দেড় একর জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে। কলাপাড়া উপজেলার বিপিনপুর গ্রামের শিববাড়িয়া নদীর তীরে দিয়ারাম এলাকায় বাস করতেন মানোয়ারা বেগম। ২০১৭ সালে রুহুল আমিন হাওলাদার তার জমিটি দখল করে নেন। ওই বিধবা উচ্ছেদ হওয়ার পর পার্শ্ববর্তী গ্রামে এক স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। দুই বছর আগে তিনি মারা গেছেন। জমিটি দখলমুক্ত করতে ২০২১ সালে তার একমাত্র সন্তান মো. ছলেমান হাওলাদার কলাপাড়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। কিন্তু জমি দখলমুক্ত করতে পারেননি। কলাপাড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, সরকারি বন্দোবস্ত দেওয়া জমি হস্তান্তর কিংবা বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। বন্দোবস্ত জমি গ্রহীতার প্রয়োজন না হলে সরকারের কাছে হস্তান্তর করবেন, এটাই নিয়ম। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।

নারী উদ্যোক্তার হোটেল দখল

মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী উদ্যোক্তা নাজনীন আক্তার স্বর্ণার নীলঞ্জনা সড়কের ১৩ শতক জমি ও নির্মাণাধীন আবাসিক হোটেল দখলের অভিযোগ রয়েছে রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে ২০১৯ সালের ১৪ মার্চ স্বর্ণা জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলনও করেছিলেন। স্বর্ণা বলেন, ২০১৯ সালের ৩ মার্চ রুহুল আমিন হাওলাদার ওই জমির দলিল লিখে দিতে তাকে চাপ দেন। কিন্তু স্বর্ণা দলিল লিখে না দিলে হাওলাদারের কেয়ারটেকার কামাল হাওলাদার বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা করেন। এই মামলায় ১১ দিন স্বর্ণাকে হাজতবাস করতে হয়। এরপর জামিনে মুক্ত হলে পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মহিববুর রহমান মহিব রুহুল আমিন হাওলাদারকে জমির দলিল করে দিতে স্বর্ণাকে চাপ দেন। বাধ্য হয়ে স্বর্ণা রুহুল আমিন হাওলাদারকে জমির দলিল লিখে দেন। দেড় কোটি টাকা মূল্যের এই জমির বিনিময়ে হাওলাদার তাকে মাত্র ৩০ লাখ টাকা দেন।

পাউবোর জমি দখল করে উল্টো মামলা

পটুয়াখালীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আফির হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৪৮ নম্বর পোল্ডারের ৩০তম কিলোমিটার অংশের ১ দশমিক ৫ একর জমি অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছেন রুহুল আমিন হাওলাদার।

কেনা ১২ একর, দখল ১৮ একর

বরিশাল-কুয়াকাটা সড়ক ধরে যেতেই তুলাতলীর মহাসড়কের পাশের বিশাল একটি এলাকা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। কয়েক মাস আগে এই জমিতে কেআর ফ্যাশনের সাইনবোর্ড ঝুলত। এখন সেই সাইনবোর্ড নেই। স্থায়ীরা জানান, কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া জমির ১২ একর রুহুল আমিন হাওলাদার বিভিন্ন জনের কাছ থেকে কিনেছেন আর অন্যের ১৮ একর জমি দখল করেছেন।

ভুক্তভোগী আব্দুর রশিদ মোল্লার ছেলে সিদ্দিক মোল্লা বলেন, ‘রুহুল আমিন হাওলাদার ভুয়া ডিক্রিমূলে ১২ একর জমি কিনেছেন এবং দখলে রেখেছেন আরও ১৮ একর জমি। অথচ জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি ওই জমি আমাদের। দলিলপত্রও আছে। আমরাই ভোগ-দখল করছিলাম। কিন্তু তিনি সাত্তার ফরাজী, কালাম ফরাজী গংকে ভুয়া মালিক সাজিয়ে পেট্রলবোমা মামলা, গার্মেন্টসে অগ্নিসংযোগসহ আরও সাত-আটটি মামলায় আমাকে আসামি করে মিথ্যা মামলা করেন। ২০২৩ সালে দায়ের করা এ রকম দুটি মামলা এখনো চলছে। একটি মামলায় আমাকে ১৯ দিন জেল খাটতে হয়েছে। তিনি আমার বৃদ্ধ মা লাইলি বেগমসহ পাঁচ ভাই ও চার বোনকে গ্রেপ্তার করিয়ে আমাদের অংশের জমি দখল করেছেন।’

গ্রেপ্তার করিয়ে ৩৬ শতাংশ জমি দখল

কুয়াকাটা বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিমে ৩৬ শতাংশ জমির মালিক শাহাজান শেখ। তার ভাই নুরুল ইসলাম, সোবাহান শেখ, আবু বকর ও বোন নাসিমা বেগম। ২০১০ সালের দিকে রুহুল আমিন হাওলাদার ওই জমি কেনার জন্য শাহাজান শেখের কাছে প্রস্তাব পাঠান। শাজাহান পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করতে আপত্তি জানালে ২০১১ সালে কুয়াকাটা পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মিজানুর রহমানকে দিয়ে তাদের মহীপুর থানায় ডেকে পাঠান। থানায় বসে শাহাজান শেখসহ তার ভাইবোনদের কাছ থেকে রুহুল আমিন হাওলাদারের অনুকূলে দলিল লিখে দেওয়ার জন্য পুলিশ চাপ সৃষ্টি করে। খবর পেয়ে কুয়াকাটা হোটেল ব্যবসায়ী সমিতির তৎকালীন সভাপতি মো. চান মিয়া থানায় মুচলেকা দিয়ে তাদের ছাড়িয়ে আনেন।

শাহাজান শেখ বলেন, ‘ওই ঘটনার ৮-১০ দিন পর চাঁদাবাজির অভিযোগে চার ভাই, বোন ও বোন জামাইসহ ছয়জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায়। গ্রেপ্তারের পর রুহুল আমিন আমাদের পৈতৃক জমি দখল করে নেন। জমিতে মাটি ফেলে উঁচু করে সামনের অংশে সীমানাদেয়াল নির্মাণ করিয়ে ‘হোটেল হানিমুন প্যালেস’-এর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেন। ওই মামলায় দুই মাস কারাভোগের পর জামিনে মুক্ত হয়ে আমরা আদালতে মামলা করি। চলতি বছরের ১৮ আগস্ট ওই মামলায় আমাদের পক্ষে রায় হয়। কিন্তু তার ক্যাডারদের জন্য আমরা ওই জমিতে ঢুকতে পারছি না।’

থমকে যায় দুদকের অনুসন্ধান

এরশাদ সরকারের আমলে বস্ত্রমন্ত্রী থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে টেন্ডার ছাড়া একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিয়ে অবৈধ পন্থায় আর্থিক লাভবান হওয়ার অভিযোগে ১৯৯১ সালে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর উপপরিচালক মো. দেলোয়ার হোসেন তেজগাঁও থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলায় রুহুল আমিন হাওলাদারকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছিল।

এ ছাড়া ২০১৮ সালে রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। এ অভিযোগের ব্যাখ্যা দিতে রুহুল আমিন হাওলাদার ও তার স্ত্রী সাবেক সংসদ সদস্য নাসরিন রত্নাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদক ২০২১ সালের আগস্টে প্রথমবার এবং একই বছরের ১০ নভেম্বর দ্বিতীয়বার তলব করে। ওই নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাওলাদার উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। আদালত প্রাথমিক শুনানি শেষে দুদকের তলব স্থগিত করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান বিরোধী দলের প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় দুদকের ওপর প্রভাব খাটানোর কারণে তার বিরুদ্ধে তদন্ত বেশি দূর এগোয়নি।

এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ সম্পর্কে গত ৮ অক্টোবর রাতে এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘কুয়াকাটা ও কলাপাড়া এলাকার স্বার্থান্বেষী মহল আমাকে সমাজে হেয় করার জন্য বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। একটি মহল ৫ আগস্টের পর আমার কেনা বিভিন্ন মৌজার জমি দখল করেছে।’

সর্বশেষ - জাতীয়