অপরাধচিত্র প্রতিবেদক: মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে সদস্য (মূসক নীতি) (চঃ দাঃ) পদে দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় থাকলেও তিনি সব পাহাড় ডিঙিয়ে এনবিআরে গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিয়েছেন চাতুরতা সাথে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশত্যাগী শেখ হাসিনার ঘোষিত ‘দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স’কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সবার সাথে তাল-মিল করে অবাধ দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বানিয়েছেন বেলাল হোসাইন। বর্তমান সরকারের সময়ও সুযোগ সন্ধানী বেলাল এনবিআরের সদস্য পদ বাগিয়ে নিয়েছেন বিশেষ কৌশলে।
এনবিআরে সদস্য পদে মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরীর নিয়োগে বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞগণ। তাদের মতে, দুদকে অভিযোগ থাকার পর কি করে এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পায় তা সরকারের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে।
অনিয়ম-দুর্নীতিতে পটু বেলাল হোসাইন চৌধুরী যেখানে চাকরি করেছেন সেখানেই ‘টাকশাল’ বানিয়েছেন। অবৈধ উপায়ে টাকা বানানোয় সিদ্ধহস্ত বেলালের বিরুদ্ধে দুদকে এই প্রথম অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে এমন নয়। তাকে একাধিকবার দুদকের তদন্তের মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রতিবারই তিনি দুদকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বদৌলতে নিজেকে ‘ধোয়া তুলসীপাতা’ প্রমাণে কামিয়াব হয়েছেন।
দুর্নীতির অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি : ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পেতে সক্ষম হয়েছেন মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী। ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরীসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা করেন বেনাপোলের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মেসার্স সাগর এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আকবর আলী।
যশোরের সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতের নির্দেশনায় ২০২২ সালের ১০ মার্চ তদন্ত শুরু করে দুদক। দীর্ঘ প্রায় এক বছরের তদন্ত শেষে ২০২৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সব আসামিকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দখিল করে যশোরের দুদক অফিস। যা পরবর্তী সময়ে ওই বছরেই কমিশনের অনুমোদন দেয় এবং সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে শুনানি শেষে আসামিদের মামলার অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বেনাপোল কাস্টমস হাউজের কমিশনার বেলাল হোসেন চৌধুরীকে তলব করেছে ঘুষ নিয়ে আটককৃত পণ্য খালাসের মাধ্যমে শতকোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ। দুদক সূত্র মতে, বেলাল হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে কিছু সি অ্যান্ড এফ এজেন্টের সঙ্গে যোগসাজশে দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নামে-বেনামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আছে। দুদক বরাতে জানা যায়, প্রাথমিক অনুসন্ধানে দুদক বেলালের নামে-বেনামে প্রায় শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়েছিল।
২০২২ সালেও বেনাপোল কাস্টম হাউসের সাবেক কমিশনার এবং শুল্ক রেয়াত ও প্রত্যর্পণ পরিদপ্তরের (ডেডো) মহাপরিচালক বেলাল হোসাইন চৌধুরীর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাব চেয়ে চিঠি পাঠায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের সই করা নোটিশে ২১ কার্যদিবসের মধ্যে সম্পদ বিবরণী দাখিলের কথা বলা হয়।
বিস্ময়কর হলেও একাধিকবার দুদকের জালে আটকা পড়লেও তিনি বরাবরই দুদকের জাল ছিন্ন করে ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন’ হয়ে পার পেয়ে যান। অনেকটা প্রকাশ্যে দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া বেলাল হোসাইন চৌধুরী এখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে নসিহত করছেন। ১১ ডিসেম্বর ভ্যাট দিবস ও ভ্যাট সপ্তাহ-২০২৪ উপলক্ষে আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাল্টিপারপাস হলে আয়োজিত সেমিনারে বেলাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, ব্যবসায়ীদের কর অব্যাহতি দেওয়ার দিন শেষ।
আয়োজিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধে মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন চৌধুরী বলেন, ৫ আগস্টের পর মূসক নিরীক্ষা গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের ৯৪টি নিরীক্ষা শেষ করে ১৫৯ দশমিক ৬৬ কোটি টাকার মূসক ফাঁকি উদঘাটন করেছে। আদায় করেছে ৬১ দশমিক ১৬ কোটি টাকা। ভ্যাট অণুবিভাগ গত ৩ মাসে ৯ হাজার ৮২৩টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন প্রদান, ভ্যাট আইন ও বিধি সংস্কারে ৮ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
আওয়ামী ঘরানার এই কর্মকর্তা ৫ আগস্টে পূর্বে ছিলেন ‘আওয়ামীঅন্তপ্রাণ’। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তার উপস্থিতি ছিল দলীয় কর্মীর মতোই। লুটেরা সরকারের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে থেকে লুটপাটের ষোলকলা পূর্ণ করেছেন বেলাল হোসেন চৌধুরী।
বেলালের অঢেল সম্পদ : সরকারের রাজস্ব ফাঁকির মাধ্যমে শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক তিনি। একাধারে গড়েছেন বাড়ি গাড়ি। দেশের বাইরেও রয়েছে বাড়ি। দুদক সূত্রে জানা যায়, ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে পণ্য খালাস করে দীর্ঘদিন থেকেই অবৈধ অর্থের মালিক হচ্ছেন বেলাল হোসেন চৌধুরী। বেনাপোল কাস্টমস হাউজে কর্মরত থেকে দিনের পর দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ দেয়ার সাহস পান না। কেউ অভিযোগ করলে তাদের নানাভাবে হুমকি দেন এই কাস্টমস কমিশনার।
সূত্র জানায়, চাকরির পাাশাপাশি নিজেরও একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ভারত থেকে আমদানি করা সাত ট্রাক মালামাল মাত্র ১১ লাখ টাকার ডিউটি আদায় করে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগও আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিজের নামে তেমন কোনো ব্যাংক ব্যালেন্স না করলেও বেলাল হোসেন চৌধুরী তার ভাই বোন ও শ্যালকের নামে বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব রয়েছে। এসব ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে বেলাল হোসেন চৌধুরীর অর্জিত অবৈধ সব অর্থ লেনদেন হয়। ঘুষ-দুর্নীতি ও রাজস্ব ফাঁকির মাধ্যমে পাওয়া টাকাগুলো তাদের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে পাচার করা হতো। বেলাল হোসেন চৌধুরীর দুর্নীতির খবর বেনাপোল কাস্টমস হাউজের সবার মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। তিনি বেনাপোল বন্দরে যোগ দেয়ার পর থেকেই কাস্টমসকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করে ছিলেন। অবৈধভাবে পণ্য লোড-আনলোডে সহযোগিতা করতেন। আর এসব তিনি করতেন মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে। বেলাল হোসেন চৌধুরী ঘুষ ছাড়া কোনো ফাইলে হাত দেন না বলে একাধিক অভিযোগ দীর্ঘদিন থেকেই চালু তার প্রত্যেক কর্মস্থলে। সূত্র জানায়, বেলাল হোসেন চৌধুরী স্ত্রী সন্তানদের নামে ঢাকায় একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট ও প্লট কিনেছেন। যার মধ্যে বারিধারার এফ ব্লকের ১২ নং রোডের ১১৯ নং প্লটে একটি বাড়ি রয়েছে তার। ৫ কাঠা জমির উপর নির্মিত ওই বাড়িটির আনুমানিক মূল্য ৫ কোটি টাকা। এছাড়া নিউ ইস্কাটনের বিয়াম ভবনের পেছনে একটি ৪ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনেছেন বেলাল হোসেন চৌধুরী। স্ত্রীর নামে কেনা ওই ফ্ল্যাটটির আনুমানিক মূল্য ৪ কোটি টাকা। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ডি ব্লকে পাঁচ কাঠা ও পূর্বাচলে ১০ কাঠা প্লট রয়েছে। এছাড়া বসুন্ধরা সিটি শপিং মল ও যমুনা ফিউচার পার্কে দুটি করে দোকানের মালিক বেলাল হোসেন চৌধুরী। রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে অর্জিত অবৈধ অর্থ তিনি কাজে লাগিয়েছেন নিজের গ্রামের বাড়িতেও। বেলাল হোসেন চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে। সেখানে সোনাইমুড়িতে ৫০ বিঘা জমি কিনেছেন। এছাড়া ভাইয়ের নামে গাজীপুরে রয়েছে একটি পোশাক কারখানাও। যার নাম সাফিনা গার্মেন্টস। ঢাকার অদূরে আশুলিয়াতেও ১০ বিঘা জমির মালিক বেলাল হোসেন চৌধুরী। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের বাইরেও সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তিনি। দুদকের সূত্রানুযায়ী, বেলাল হোসেন চৌধুরী বিপুল অংকের অর্থ পাচার করেছেন। আর সে অর্থ দিয়ে সেখানে একটি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন। শুধু তাই নয় ছেলে মেয়েদেরও কানাডাতেই পড়ালেখা করাচ্ছেন বেলাল হোসেন চৌধুরী।