নিজস্ব প্রতিবেদক :
এক মাস পর ভারতীয় সীমান্ত থেকে উদ্ধার হল ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসিবুর রহমান হিমেল। মঙ্গলবার রাতে হিমেলকে উদ্ধার করে র্যাব। এ সময়, আগেয়াস্ত্রসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আজ বৃহস্পতিবার র্যাবের কারওয়ান বাজার কার্যালয়ে এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন।
২৬ ডিসেম্বর রাজধানীর উত্তরা থেকে অপহরণ করা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিমেলকে। এরপর সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে অবস্থান নিয়ে মুক্তিপণের দাবিতে এমন নির্যাতন করা হয় তাকে। একটি বিদেশি নম্বর ব্যবহার করে এসব ভিডিও হোয়াটসঅ্যাপ মাধ্যমে পাঠানো হয় হিমেলের মায়ের কাছে। শুরুতে মুক্তিপণ চাওয়া হয় দুই কোটি টাকা। সবশেষে যা চূড়ান্ত হয় ৩০ লাখ টাকায়। ৬ জানুয়ারি হিমেলের মায়ের করা মামলা ধরে তদন্ত শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
র্যাবের দাবি, শুরুতে ধরা পড়ে অপহরণ চক্রের দুই সদস্য। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে তাহিরপুরের সুন্দরবন গ্রামে হিমেলকে আটকে রাখার তথ্য পায় র্যাব। দুর্গম ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করা হয় ৩ জনকে।
খন্দকার আল মঈন জানায়, অপহরণকারি চক্ররা পেশাদার অপরাধী। মূলহোতা মালেকের বিরুদ্ধে রয়েছে ১৪টি অপহরণ মামলা।
এর পাশপাশি ভারতীয় ২-৪ জনকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে হাওরে আটকে রেখে টাকা আদায় করেছে। এই চক্রের একজন আব্দুল মালেক ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সাড়ে তিন বছর কারাভোগের পরে মুক্তি পান। বের হয়ে আবারও এই কাজে নেমে পড়েন।
বাবা মারা যাওয়ায় পড়াশোনার পাশাপাশি পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা করতেন তিনি। গত ২৬ ডিসেম্বর নিজেদের গাড়ি নিয়ে ব্যবসার কাজে শেরপুরের দিকে রওনা দেওয়ার পর চালক সামিদুলসহ নিখোঁজ হন হিমেল।
র্যাব জানায়, গাড়িচালক সামিদুলই অপহরণ চক্রটিকে তথ্য দেন যে তাকে অপহরণ করলে ভালো টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই অনুযায়ী তারা তাকে অপহরণের পরিকল্পনা করে। নির্বাচন নিয়ে যখন সারা দেশের আইন-শৃঙ্খলারক্ষী বাহিনীগুলো ব্যস্ত। সেই ফাঁকে তারা হিমেলকে তুলে নিয়ে যায়। তারা ২৮ ডিসেম্বরেই তাকে নিয়ে মেঘালয়ে চলে যায়। এরপর তাকে উদ্ধার করতে সবগুলো সংস্থা উঠেপড়ে লাগে। অপহরণকারীরা তাকে নিয়ে মেঘালয়ের পাহাড়ি অঞ্চলে থেকেছে। সেখানে তারা নাগালের বাইরে ছিল। ভারতের পুলিশের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করে তারা জানতে পারে, এই চক্রের সদস্যরা এর আগে এক-দুইজন ভারতীয়কে বাংলাদেশের সীমানায় এনে নৌকায় আটকে রেখেছিল।
শুধুমাত্র মুক্তিপণ আদায়ের জন্য তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। র্যাব জানায়, প্রথমে তাদের দাবি ছিল দুই কোটি টাকা। পরে সেটা ৩০ লাখ টাকায় নামে। মাঝখানে তারা কিছু অপপ্রচারও চালায়। তবে তাদের মূল লক্ষ্য ছিল টাকা পাওয়া।
র্যাব জানায়, এ ঘটনায় রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় নিখোঁজ সংক্রান্তে একটি সাধারণ ডায়রি করে পরিবার। এরপর গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর গাজীপুরের বাসন এলাকায় পরিত্যাক্ত অবস্থায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তার গাড়িটি উদ্ধার করে। পরবর্তীতে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তার মায়ের হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করে হিমেলকে অপহরণের বিষয়টি জানায়। এরপর তার পরিবারের কাছে ২ কোটি টাকা মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করে। টাকা না দিলে তারা পাশবিক কায়দায় নির্যাতনের ভিডিও ভিকটিমের পরিবারের কাছে পাঠায়। এমতাবস্থায় অপহৃতের মামা বাদী হয়ে রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় ৬ জানুয়ারি একটি অপহরণের মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নং-৬। ভিকটিমের মা তার ছেলেকে উদ্ধারে র্যাবের কাছেও অভিযোগ দায়ের করেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা অপহরণের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, অপহরণ চক্রের মূলহোতা গ্রেপ্তারকৃত মালেক এবং অন্যতম পরিকল্পনাকারী গ্রেপ্তারকৃত ছামিদুল। গ্রেপ্তারকৃত ছামিদুল হিমেলের বাসায় চার বছর যাবত গাড়ি চালক হিসেবে চাকরি করায় সুসম্পর্ক তৈরি হয়। তাদের পারিবারিক আর্থিক ও সম্পত্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য সে জানতো।
গত ১৬ ডিসেম্বর মালেকের নেতৃত্বে গ্রেপ্তারকৃতরা উত্তরার একটি জায়গায় সমবেত হয়। মালেক ও ছামিদুল হিমেলকে অপহরণ করে তার পরিবারের নিকট থেকে বিপুল অংকের মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনার বিষয়টি তাদের অন্যান্য সহযোগীদের জানায়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গ্রেপ্তারকৃত ছামিদুল ভিকটিম হিমেলকে শেরপুরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যাটারি বিক্রয়ের সম্ভাবনার কথা জানিয়ে হিমেলকে শেরপুরে যেতে আগ্রহী করে।
গত ২৬ ডিসেম্বর সকালে ভিকটিম শেরপুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা করলে ছামিদুল মালেককে বিষয়টি অবহিত করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্রেপ্তারকৃত মালেক ও অন্যান্য সহযোগীরা ৩/৪টি মোটরসাইকেল যোগে ভিকটিমের গাড়ি অনুসরণ করতে থাকে এবং গাজীপুরের সালনায় এলাকায় পৌঁছালে গ্রেপ্তারকৃতরা মোটরসাইকেল দিয়ে ভিকটিমের গাড়িটি আটকায়।
এ সময় তারা ভিকটিম ও ছামিদুলকে গাড়ির পেছনে বসায় ও গ্রেপ্তারকৃত রনি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে এবং রাসেল গাড়ি চালাতে থাকে। গ্রেপ্তারকৃত মালেক ও অন্যান্যরা মোটরসাইকেল যোগে গাড়িটি অনুসরণ করতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে তারা ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী এলাকা ধোবাউড়ায় পৌঁছায়। রাসেল ও বিল্লাল তাদেরকে ধোবাউড়ায় পৌঁছে দিয়ে গাড়িটি নিয়ে গাজীপুরে এসে গাজীপুরের বাসন এলাকায় রাখে এবং বিল্লাল পুনরায় ময়মনসিংহ চলে যায়। গ্রেপ্তারকৃত রাসেল উত্তরাতে ভিকটিমের মায়ের গতিবিধি অনুসরণ করতো বলে জানা যায়।