শুক্রবার , ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৩ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অপরাধ
  2. অপরাধচিত্র বিশেষ
  3. আইন-আদালত
  4. আন্তর্জাতিক
  5. খুলনা
  6. খেলাধুলা
  7. চট্রগ্রাম
  8. জাতীয়
  9. জেলার খবর
  10. ঢাকা
  11. তথ্য-প্রযুক্তি
  12. প্রবাসের কথা
  13. বরিশাল
  14. বিনোদন
  15. ব্যাবসা-বাণিজ্য

আতশবাজি ও ফানুসে বাড়ছে বায়ু ও শব্দ দূষণ

প্রতিবেদক
Newsdesk
ডিসেম্বর ২৭, ২০২৪ ৯:২১ অপরাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক :

ইংরেজি নববর্ষ উদ্যাপনে আতশবাজি পোড়ানো ও ফানুস ওড়ানো এখন ট্রেন্ড হয়ে দাড়িয়েছে। সরকারিভাবে বিধি-নিষেধ থাকলেও মান্য করছে না নগরবাসী। ৩১ ডিসেম্বর রাত ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি দূষিত হয়ে রাজধানীর আকাশ-বাতাস। গত সাত বছরে আতশবাজি পোড়ানো ও ফানুস ওড়ানোর কারণে রাজধানীতে বায়ুদূষণ বেড়েছে গড়ে ১৯ শতাংশ। একই কারণে এ সময় শব্দদূষণ বেড়েছে গড়ে ৭৪ শতাংশ।

শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে নববর্ষে আতশবাজি পোড়ানো-ফানুস ওড়ানোর কারণে সৃষ্ট বায়ু ও শব্দদূষণ নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ এবং আতশবাজি-ফানুসমুক্ত নববর্ষ উদ্যাপনের দাবিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্যই জানানো হয়েছে। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়নকেন্দ্র (ক্যাপস) এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। ক্যাপসের চেয়ারম্যান ও বেসরকারি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার গবেষণার ফল উপস্থাপন করেন।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গবেষকেরা গত সাত বছর ৩১ ডিসেম্বর দিবাগত রাতের সময়টার ঢাকার বায়ুমান নির্ণয় করেছেন। নববর্ষ উদ্যাপনের রাতে ঢাকায় এই সাত বছরে সর্বোচ্চ ৬৬ শতাংশ থেকে সর্বনিম্ন ৬ শতাংশ পর্যন্ত বায়ুদূষণ বেড়েছে। এই সময়ে শব্দয়ুদূষণ বেড়েছে গড়ে ১৯ শতাংশ। তবে করোনার সময়ে (২০২১-২২ সাল) এই দূষণ কমে গিয়েছিল। শব্দদূষণের ফল তুলে ধরে কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, এই সাত বছরে ঢাকায় গড়ে ৭৪ শতাংশ শব্দদূষণ বেড়েছে। গত সাত বছরই শব্দের মাত্রা ৭০ ডেসিবেল অতিক্রম করেছে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর নববর্ষের রাত ১১-১২টার তুলনায় পরবর্তী এক ঘণ্টার বায়ুদূষণ ৩৬ শতাংশ বেড়ে যায়। ২০২৪ সালে তা ৩৫ শতাংশ বেড়েছিল। নববর্ষ উদ্যাপন ঘিরে ২০২৩ সালে শব্দদূষণ ১০২ শতাংশ ও ২০২৪ সালে ৪২ শতাংশ বেড়ে যায়। গবেষণায় বলা হয়, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল এই সময়ের মধ্যে বায়ুমান সূচক কখনোই ভালো অবস্থানে ছিল না। বায়ুমান সূচক ৫০-এর নিচে থাকলে তাকে ‘ভালো বায়ু’ বলা হয়। সে ক্ষেত্রে গত সাত বছরে নির্দিষ্ট দুই দিনে (৩১ ডিসেম্বর ও ১ জানুয়ারি) কখনোই বায়ুমান সূচক ৫০-এর নিচে নামেনি।

গবেষণার তথ্য অনুসারে, ৩১ ডিসেম্বর রাতে নববর্ষ উদ্যাপনের আগের তিন ঘণ্টার গড় বায়ুমান থেকে নববর্ষ উদ্যাপন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমান অবনতি হতে শুরু করে। রাত ১২টা বাজার কিছু আগে থেকে আতশবাজি পোড়ানো, ফানুস ওড়ানো শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বায়ুদূষণও বাড়তে থাকে। বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ২.৫) উপস্থিতি রাত একটায় প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে ২৪৯ মাইক্রোগ্রামে পৌঁছায়, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, মাত্রাতিরিক্ত শব্দ ও বায়ুদূষণ মানুষ, পশু-পাখি উদ্ভিদ সহ সার্বিক প্রাণ-প্রকৃতির উপর ব্যাপক খারাপ প্রভাব ফেলছে। আতশবাজি এবং ফানুসের পরিবর্তে আলোকসজ্জা, প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করা এবং সীমিত শাব্দে দেশীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন বছর উদযাপন করা যেতে পারে। আমরা কখনই চাইনা উৎসব-আনন্দে আইনের কঠোরতার মধ্য দিয়ে পার করি। সুস্থ্য নির্মল পরিবেশই আমাদের কাম্য।

অনুষ্ঠানে কিডস টিউটোরিয়াল স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী ওয়াজিহা জামান তার ছোট জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলে, সব শিশুরা আতশবাজির শব্দে আনন্দিত হয় না, অনেক শিশুরা ভয়ও পায়। তাই সবার কাছে অনুরোধ বর্ষ উদযাপনে আতশবাজি না পুড়িয়ে। অন্য কোন পরিবেশবান্ধব উপায়ে উদযাপন করুন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুস স্যারের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে তিনি যেন আতশবাজি এবং ফানুস পোড়ানো কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম. শহিদুল ইসলাম বলেন, এর আগে আতশবাজি নিয়ে গবেষণা করার কোন ইতিহাস বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুঁজে পায় নাই। এই আতশবাজি পোড়ানোর কারণে মানুষের সাংস্কৃতিক বিপর্যয়, শারীরিক বিপর্যয় এবং জীববৈচিত্রোর বিপর্যয় ঘটছে। তিনি নিজের একটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন যে, ৩১ ডিসেম্বর রাত বারোটা থেকে ২ টা পর্যন্ত তাকে নিজের ছাদে পাহারা দিতে হয় যেন কোন ফানুস এসে তার শখের বাগানকে ধ্বংস করে না ফেলে। তিনি নতুন বছরে সবাইকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহবান জানান।

প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ করার পরিণতি কখনো ভালো হয় না উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, বায়ু দূষণের ফলে উদ্ভিদের খাদ্য উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। একটি এলাকার বায়ুদূষণ অথবা শব্দ দূষণের কারণে ওই এলাকার ইকো সিস্টেমে যত পোকামাকড় থাকে সেগুলো নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্য অন্যত্র চলে যায়। এর কারণে উদ্ভিদের প্রজননের ক্ষেত্রেও একটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। একটি আতশবাজি ফোটানোর কারণে যে এত বড় একটা প্রভাব বিস্তার করে সেটি আমাদের কল্পনারও বাইরে।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ প্ল্যানার্স এর সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, নববর্ষ উদযাপনে আতশবাজি ও ফানুস পেড়ানোর প্রচলন যে সকল দেশ থেকে শুরু হয়েছিল তারাই এগুলো পোড়ানোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। ফানুসের সাথে প্রেমিকার তুলনা না করে এর ক্ষতিকর দিকগুলো সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। আতশবাজি না পুড়িয়ে দেশীয় সংস্কৃতি অর্থাৎ নাটক, মঞ্চ নাটক, গান, দেশীয় নাচ ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়িয়ে গিয়েই আমাদের নববর্ষকে বরণ করতে পারি।

পরিবেশবিদ, গবেষক ও লেখক আশিকুর রহমান সমী বলেন, সবুজে ভরা বাংলাদেশে আমরা যোগ করেছি পৈচাশিক উদযাপনের সংস্কৃতি। আতশবাজি পোড়ানোর কারণে অনেক পাখি আতঙ্কে আকাশে উড়ে। গবেষণায় দেখা যায়, লক্ষ্মী পেচা একটি কৃষকের ২৫ লক্ষ টাকার ফসল রক্ষা করতে পারে। আমাদের স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে যেন শিশুরা এবং তরুণরা বুঝতে পারে যে এই আতশবাজি ও ফানুস পোড়ানোর যে নেতিবাচক একটি দিক আছে।

সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী অ্যাড, রাশেদুজ্জামান মজুমদার বলেন, আতশবাজি আমদানি রপ্তানি করার কাপারে বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই আইনের প্রচলন রয়েছে কিন্তু এর কোন সুষ্ঠু প্রয়োগ এখনো লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কয়েক বছর ধরেই সরকারিভাবে এসবকে নিষিদ্ধ করে পরিপত্র জারি করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিবছরই নববর্ষের সময়টাতে শত শত অভিযোগ কল আসে ৯৯৯-এ, কিন্তু এখন পর্যন্ত একজনকেও শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। আইন কিংবা শুধুমাত্র নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দায় এড়ানোর প্রবণতা বন্ধ করে আমাদের আইনের প্রয়োগ করতে হবে।

আরন্যক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক, ইন্সটিটিউশন অফ ফরেস্টার্স বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক রকিবুল হাসান মুকুল ক্যাপসকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এটি একটি যুগান্তকারী গবেষণা। আমি ক্যাপসকে অনুরোধ করবো এই ধরনের গবেষণা চালিয়ে যেতে।

বায়ু ও শব্দ দূষণের প্রভাব ॥ নববর্ষ উদযাপনের সময় বায়ু এবং শব্দ দূষণের ফলে মানুষের জীবন ও পরিবেশের ওপর গুরুতর প্রভাব পড়ছে। বায়ুদূষণের উচ্চ মাত্রা শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। ৮০-৯০ ডেসিবলের শব্দ দীর্ঘ সময় ধরে মানুষের শ্রবণশক্তি নষ্ট করতে পারে। উচ্চ শব্দের কারণে অনিদ্রা, মানসিক চাপ, এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। আতশবাজি এবং পটকার কারণে পাখিরা আতঙ্কিত হয়ে উড়ে যায়। প্রায়ই গাছে বা ভবনের সাথে ধাক্কা খেয়ে তারা আহত হয় বা মারা যায়। ২০২৪ সালের নববর্ষে হাজারো পাখি আহত হয়েছিল। উচ্চ শব্দ এবং দূষণের কারণে বন্যপ্রাণীদের প্রাকৃতিক আচরণে পরিবর্তন ঘটে। তাদের খাদ্য সংগ্রহ ও প্রজনন প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি হয়। বায়ু দূষণ গাছপালার বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে এবং মাটির উর্বরতা নষ্ট করে। দীর্ঘমেয়াদে মাটিতে ভারী ধাতুর উপস্থিতি বাড়ে, যা খাদ্য উৎপাদনে প্রভাব ফেলে।

এই গবেষণায় বায়ুদূষণ ও শব্দদূষণ রোধে কয়েকটি সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে দূষণ সৃষ্টিকারী আতশবাজি ও ফানুসের আমদানি, উৎপাদন, বিক্রয় ও সরবরাহে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ। আতশবাজি এবং ফানুসের পরিবর্তে আলোকসজ্জা, প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করা এবং সীমিত শব্দে দেশীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে করা যেতে পারে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিবেশ সুরক্ষার বার্তা ছড়ানোর জন্য ব্যবহার করতে হবে। শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ এবং অন্যান্য পরিবেশ সুরক্ষা আইনের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। নববর্ষ উদযাপনের সময় পশু-পাখি এবং বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তার জন্য সুরক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দূষণ নির্ধারণ এবং তার প্রভাব কমানোর জন্য গবেষণায় আরও বেশি তহবিল বরাদ্দ করতে হবে।

 

 

 

সর্বশেষ - জাতীয়