ফেনী প্রতিনিধি :
জেলাজুড়ে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি শুরু হবে। এখন পর্যন্ত ৫০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৪ উপজেলায় প্রায় ৭ হাজার মানুষ আশ্রিত রয়েছেন।
ভারত থেকে নেমে আসা বাঁধভাঙা পানি পরশুরাম ও ফুলগাজী থেকে গড়িয়ে ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে পড়েছে। গতকাল পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২১টি স্থানে ভেঙে অন্তত শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কবলিত গ্রামের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
বৃষ্টি ও নদীর পানি কমায় পরশুরামে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও ফুলগাজীতে শুক্রবার ( ১১ জুলাই) সকাল পর্যন্ত স্থিতিশীল অবস্থা দেখা গেছে। এতে সীমান্তবর্তী ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদরের আংশিক নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। বিভিন্ন সড়ক পানিতে তলিয়ে গিয়ে বন্ধ রয়েছে যানচলাচল। বন্যাকবলিত এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ ও নেটওয়ার্ক না থাকায় বিপাকে পড়েছেন মানুষজন। এদিকে, ফেনীতে বন্যার পানিতে মাছ শিকারে যাওয়া বৃদ্ধের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
তবে বাঁধভাঙা পানিগুলো ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ঢুকে নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত করছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি কমে আসায় নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রশাসন, বিভিন্ন সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবীরা দুর্গত এলাকাবাসীর পাশে থেকে মানবিক সেবা দিয়ে যাচ্ছে। আজ শুক্রবার এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ফেনী-ফুলগাজী ও ফেনী-ছাগলনাইয়া আঞ্চলিক সড়কের ওপর দিয়ে ১ থেকে ২ ফুট পর্যন্ত পানির প্রবাহ রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, গত সোমবার থেকে ভারী বর্ষণের কারণে শুক্রবার পর্যন্ত ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরামে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২১টি স্থান ভেঙে যায়। এতে ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার অন্তত শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বুধবার থেকে বৃষ্টি কমতে শুরু করায় সকাল থেকে পরশুরাম উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে থাকে। তবে বন্যার পানি ফুলগাজী হয়ে ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলায় ঢুকতে শুরু করে।
ফুলগাজীর দৌলতপুর এলাকার বয়োবৃদ্ধ রেজিয়া বেগম বলেন, গেল বছরের বন্যার বছর না ঘুরতেই আবারও পানিতে ডুবতে হয়েছে। সব জিনিসপত্র ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। এ অঞ্চলে জুলাই-আগস্ট মাসে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ভাঙন এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। সব মিলিয়ে মাঝেমধ্যে মনে হয়, এখানে জন্মগ্রহণ করে ভুল করেছি।
উত্তর শ্রীপুর এলাকার বাসিন্দা আলী আজ্জম বলেন, বাঁধের ভাঙনস্থানে তীব্র স্রোতে পানি ঢুকছে। সময়ের সঙ্গে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। গেল বছরের বন্যার মতো এবারও বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে। রাজনৈতিক দল বা ক্ষমতা পরিবর্তন হলেও আমাদের ভাগ্য কখনো পরিবর্তন হয় না।
গাইনবাড়ি এলাকার বাসিন্দা পুষ্পিতা রাণী বলেন, ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে গেছে। পরিবারের শিশু ও বয়স্কদের নিয়ে অবর্ণনীয় কষ্ট করতে হচ্ছে। নিরাপদ পানির সংকটে আরও বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু কর্মকর্তার দায়সারা কাজের জন্য প্রতিবছর এ জনপদে ভাঙন নিয়মে পরিণত হয়েছে। আমাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য একমাত্র টেকসই বাঁধই সমাধান।
ফেনী সদরের মোটবী ইউনিয়নের নজরুল ইসলাম বলেন, বুধবার রাত থেকে আমাদের ইজ্জতপুর গ্রামে পানি বাড়তে থাকে। শুক্রবার সকাল পর্যন্ত সড়কের কোথাও কোথাও ৩ থেকে ৪ ফুট পর্যন্ত ডুবে গেছে। এলাকার সব পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। অনেকেই গরু-ছাগল নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন।
ফেনীর আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ৫৮ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ক্রমাগত বৃষ্টিপাত কমছে। তাই আজ শুক্রবার থেকে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী আকতার হোসেন মজুমদার বলেন, মুহুরী নদীর পানি ১ দশমিক ৯৩ মিটার বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফুলগাজী এলাকার বন্যাকবলিত গ্রামগুলোতে পানির অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। পানির চাপ কমে যাওয়ায় নতুন করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভাঙার আশঙ্কা নেই। পানি কমে গেলেই ভাঙনকবলিত স্থানগুলো মেরামত করা হবে।
ফেনী জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ফেনীতে কবলিত ৪ উপজেলার মধ্যে পরশুরামে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। ফুলগাজীতেও কিছুটা ভালো অবস্থায় রয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার বন্যার পানি ছাগলনাইয়ার প্রধান সড়ক গড়িয়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত করছে। আশা করি শুক্রবার পর্যন্ত জেলাজুড়ে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি শুরু হবে। এখন পর্যন্ত ৫০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৪ উপজেলায় প্রায় ৭ হাজার মানুষ আশ্রিত রয়েছেন। ২০ হাজারেরও বেশি বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে খাবার সরবরাহের জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরাও কাজ করে যাচ্ছেন।
বৃদ্ধের মরদেহ উদ্ধার
ফেনীতে বন্যার পানিতে মাছ শিকার করতে যাওয়া নুরুল আলম (৫০) নামের এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতে ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর ইউনিয়নের বন্দুয়া দৌলতপুর এলাকা থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত নুরুল আলম ওই এলাকার মুক্তিযোদ্ধা সাদেক কমান্ডারের ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, গত দুই দিন ধরে জ্বর-ব্যথায় ভুগছিলেন নুরুল আলম। বৃহস্পতিবার একটু সুস্থতা অনুভব করে ভোর ৫টার দিকে তিনি বাড়ির সংলগ্ন স্থানে মাছ শিকার করতে যান। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি ঘরে না ফেরায় পরিবারের লোকজন খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। এক পর্যায়ে মাছ শিকারের স্থান থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহরিয়া ইসলাম বন্দুয়া দৌলতপুর এলাকা থেকে মাছ শিকারে যাওয়া ওই ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।