নিজস্ব প্রতিবেদক :
তাড়াহুড়া করে এমপি ও মন্ত্রীদের শপথই প্রমাণ করে, ক্ষমতাসীনদের অজানা আতঙ্ক ঘিরে ধরেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। আজ শুক্রবার (১২ জানুয়ারি) সকালে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই প্রতিক্রিয়া জানান।
রুহুল কবির রিজভী বলেন, বাংলাদেশে রাজনীতির ইতিহাসে ডামি প্রার্থী, ডামি ভোটার, ডামি এজেন্ট, ডামি পর্যবেক্ষক, ডামি ফলাফল, ডামি এমপি, ডামি শপথের মধ্য দিয়ে গতকাল (বৃহস্পতিবার) ওয়ান-ইলেভেনের কৃষ্ণতম দিবসে একদলীয় ফ্যাসিবাদের হুংকারে আরেকটি কৃষ্ণতম মেকি সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশের জনগণ এবং গণতান্ত্রিক বিশ্ব এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে জনগণ ডামি নির্বাচন বর্জন করে চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
এর সঙ্গে জড়িত প্রক্রিয়া, ব্যক্তি, ফলাফল, শপথ, সংসদ, সরকার―সব কিছুই প্রত্যাখ্যাত, অগ্রহণযোগ্য।
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরপরই সরকার গঠনের প্রসঙ্গ টেনে রিজভী আরো বলেন, ‘ভুয়া ভোট শেষ হতে না হতেই শেখ হাসিনা নিশিরাতের সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই গেজেট জারি, তড়িঘড়ি শপথ ও নজিরবিহীন দ্রুততায় সরকার গঠনের ঘটনা প্রমাণ করে এক অজানা ভীতি-আতঙ্ক ঘিরে ধরেছে তাকে। সমস্ত কিছু অবৈধ-ভুয়া আর জালিয়াতির আবর্তে তাসের ঘরের ওপর সিংহাসন পাতলে এমন নির্ঘুম অনিশ্চয়তা আতঙ্কে জীবন পতিত হয়।’
তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার এই মন্ত্রিসভা নিয়ে আমরা কী বলব? এটা ডামি…এই মন্ত্রিসভা নিয়ে কথা বলতে চাই না।
যদি একটা বৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে কিছু হতো তাহলে বলা যেত। এটা তো সব দিক থেকে বর্জন করেছে জনগণ।’
গতকাল বৃহস্পতিবার বঙ্গভবনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান।
২৮ অক্টোবর সমাবেশের ঘটনায় টানা ৫৭ দিন বন্ধ থাকা নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় খোলার পর এই প্রথম সংবাদ সম্মেলন করলেন রিজভী। এর আগে তিনি আত্মগোপনে থেকে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দলের বক্তব্য উপস্থাপন করতেন।
তিনি বলেন, ‘আবারও অনেক দিন পরে আপনাদের সঙ্গে দেখা হলো। আমরা জানি না, আমাদের পরিস্থিতি পরিণাম কী হবে? আমরা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যে আছি। আপনারা এর মধ্যেও সহযোগিতা করেছেন, এ জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
’রিজভী বলেন, ৭ জানুয়ারি তথাকথিত নির্বাচনটি ছিল গণতন্ত্রকামী জনগণের আন্দোলনের পক্ষে এবং ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ডামি নির্বাচন বর্জনের পক্ষে একটি সুস্পষ্ট গণরায়। এই ডামি সরকার ওয়ান-ইলেভেনের ধারাবাহিকতা মাত্র।
তিনি বলেন, ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির এই দিনে গভীর ষড়যন্ত্রের নীলনকশার মাধ্যমে দেশটাকে প্রভুদের করদ রাজ্যে পরিণত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় আবারও সেই একই দিনে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করল ডামি ভোটের অসাংবিধানিক, প্রভুদের আজ্ঞাবাহী হাসিনার সরকার। দেশকে তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র তারা সফল করল।
দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব গণতন্ত্রের বিনিময়ে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশালের দ্বিতীয় সংস্করণ চালু করলেন শেখ হাসিনা। বিদেশি পত্রপত্রিকা মিডিয়া এবং রাজনীতি বিশ্লেষকরা সোচ্চার কণ্ঠে বলছে, বাংলাদেশে একতরফা একদলীয় ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে একদলীয় রাষ্ট্র কায়েম করেছেন শেখ হাসিনা। এটা বাকশাল ২.০।
রিজভী বলেন, আওয়ামী লীগের পরাজিত নেতারাই শেখ হাসিনাকে অবৈধ ভোটের প্রধানমন্ত্রী উপাধি দিচ্ছেন। এবার যে নির্বাচনের নামে ভোট ডাকাতি হয়েছে তা নিজেরাই সংবাদ সম্মেলন করে তুলে ধরছেন।
সংসদে বিদ্যুৎ বিক্রি করা এক গানের শিল্পী বলেছেন, মৃত মানুষ, বিদেশে আছে, তাদের ভোটও দেওয়া হয়েছে, আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থী ও দলটির প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ বলেছেন, নির্বাচনে অলৌকিক শক্তি কাজ করায় ভোটে কারচুপি হয়েছে…একচেটিয়া ভোট ডাকাতি হয়েছে। বরগুনা-১ আসনের আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বলেছেন, ভোটের ফল এক হাতে তৈরি করা হয়েছে…একজন বলেছেন, গণভবন থেকে ফলাফল এসেছে। পরাজিত কুইন্স পার্টির এক নেতা বলেছেন, শেখ হাসিনা তামাশার নাটক করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘কাকে কত টাকা দিয়ে নির্বাচনে নেওয়া হয়েছে তা প্রকাশ্যে হিসাব দিচ্ছেন পরাজিত প্রার্থীরা। থলের বিড়াল সব বের হচ্ছে আস্তে আস্তে। সব অপকর্মের খবর ফাঁস করছে। এত দিন বাংলাদেশ তথা বিএনপি বলেছে শেখ হাসিনা ভোট ডাকাত আর এখন আওয়ামী লীগের লোকজনই বলছে শেখ হাসিনা ভোট চোর, শেখ হাসিনা ভোট ডাকাত।’
রিজভী বলেন, বাংলাদেশের জনগণের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। প্রতারণার মাধ্যমে শেখ হাসিনার উপহার দেওয়া দিবানিদ্রায় থাকা নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে ভেজাল নির্বাচন ও কণ্ঠ রোধের গণতন্ত্র তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। বিরোধীদের সমালোচনার ওপর সরকারের বুলডোজার চালানোর ঘটনা সর্বজনবিদিত। এই প্রতারণার ডামি নির্বাচনকে কেউ স্বীকৃতি দেয়নি।
রিজভী বলেন, অচিরেই এই সরকার চোরাবালিতে হারিয়ে যাবে। কারণ এরা অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য নিপীড়নের সব রেকর্ড ভেঙে বিশ্বমানবতার শত্রু হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এদের নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যাচার ও উৎপীড়নের কাহিনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। যেহেতু জনসমর্থনহীন সরকার জবাবদিহির ধার ধারে না, সেহেতু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিনকে দিন বেপরোয়া ও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এরা এমন একটি দুর্নীতির সংস্কৃতি তৈরি করেছে, যার মাধ্যমে তারা কল্পস্বর্গ বানিয়ে আনন্দে আত্মহারা।
রিজভী বলেন, ‘অনেকেই অসুস্থ…দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী তারা গুরুতর অসুস্থ। কিন্তু তারা চিকিৎসা পাচ্ছেন না। এ রকম অসংখ্য নেতাকর্মী অসুস্থ। আমাদের সহপ্রচার সম্পাদক কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম আমি খবর পেয়েছি প্রচণ্ড অসুস্থতায় ভুগছেন কারাগারের মধ্যে। তার ওপর অনেকবার নিপীড়ন-নির্যাতন হয়েছে…তাকে ফেলে দিয়ে পায়ের ওপর বুট দিয়ে খোঁচানো হয়েছে। সে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে ফুল দিতে যাওয়ার সময় শটগানের গুলিতে তার পা ঝাঁঝরা…প্রচণ্ড অসুস্থ সে। কিন্তু তার জন্য কোনো ধরনের চিকিৎসা নেই…সে সেখানে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।’
তিনি বলেন, সরকারের দমন-পীড়ন অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিনই দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ২৫ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং ২১৬ জন নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ, ঢাকা জেলা সভাপতি খন্দকার আবু আশফাক, কেন্দ্রীয় নেতা রফিকুল ইসলাম, তারিকুল ইসলাম তেনজিং, আমিনুল ইসলাম, মহানগর দক্ষিণের নাদিয়া পাঠান পাপন, ড্যাবের তৌহিদ আউয়াল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।