নিজস্ব প্রতিবেদক :
‘বাংলাদেশে কোনো টেকসই সড়ক পরিবহন কৌশল নেই। সড়ক পরিবহনে আইন-কানুন, নীতি-নৈতিকতার তেমন গুরুত্ব ও প্রয়োগ নেই। ছয় বছর আগে ২০১৮ সালে সড়ক পরিবহন আইন প্রণীত হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।’
আজ শনিবার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে ‘সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোগত সংস্কার বিষয়ে জাতীয় সংলাপ’ শিরোনামে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, রাজধানীতে কম্পানীভিত্তিক বাস সার্ভিস চালু করলে নগরবাসী ব্যক্তিগত যানবাহন ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হবে। এতে যানজট কমবে। যানজট কমলে ঝুঁকিপূর্ণ মোটর সাইকেলের ব্যবহার কমবে। নগরীর সাধারণ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ সহজ ও সাশ্রয়ীভাবে যাতায়াত করতে পারবেন।
তারা বলেন, গণপরিবহন ৫৩ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করে, আর ব্যক্তিগত যানবাহন মাত্র ১১ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করে। অথচ ব্যক্তিগত যানবাহন ৭০ শতাংশ সড়ক দখল করে চলে। এটা সাধারণ মানুষের প্রতি চরম বৈষম্য। রাজধানীতে মোটরবাইক ও ব্যক্তিগত যানবাহন নামাতে আইনগত কোনো বাধা নেই।
কিন্তু বাস-মিনিবাস নামাতে রয়েছে নানা বাধা।
বক্তারা বলেন, অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ মোটরযান, অনুপযুক্ত সড়ক, মালিক শ্রেণির অপেশাদারী ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় অগনিত মানুষ নিহত হচ্ছে। অসংখ্য মানুষ আহত ও পঙ্গু হচ্ছে। কিন্তু এসব দুর্ঘটনার দায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিচ্ছে না। জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার অভাবে দায়ীদের শাস্তি হচ্ছে না।
সংজ্ঞা অনুযায়ী বাংলাদেশের অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। সড়ক, যানবাহন ও চালক সঠিক থাকার পরেও যদি দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে সেটা দুর্ঘটনা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলাজনিত কারণে দুর্ঘটনার সহায়ক উপাদান বিদ্যমান থাকায় যখন দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটে তখন তা অবশ্যই কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডের দায় কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না।
তারা বলেন, ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ) নামের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার কাজের কোনো সফলতা নেই। মানুষ এই প্রতিষ্ঠান চেনেই না। তাই সংস্কারের মাধ্যমে ডিটিসিএ কার্যকর করতে হবে। রাজধানীর সড়ক ব্যবস্থাপনার সাথে সিটি করপোরেশনের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের সাথে বিআরটিএ এবং ডিটিসিএর সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে।
তারা আরো বলেন, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ করে। সড়ক নিরাপত্তার সাথে মানসম্পন্ন সড়কের নিবিড় সম্পর্ক। কিন্তু সড়কের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ। পত্রিকার তথ্যমতে, গত ১৪ বছরে সড়ক নির্মাণে ৫০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশে ৯ হাজার কিলোমিটার মহাসড়ক রয়েছে। কিন্তু হাইওয়ে পুলিশ মাত্র ৩ হাজার কিলোমিটার কোনো রকমে নজরদারী করতে পারে। প্রযুক্তিগত সক্ষমতাসহ হাইওয়ে পুলিশের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ২ লাখ ৭০ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক রয়েছে। এই সড়ক নির্মাণ করে এলজিইডি। গ্রামীণ সড়কগুলো মহাসড়কের সাথে সরাসরি মিশিয়ে দেয়া হয়। ফলে গ্রামীণ সড়কের ছোট ছোট যানবাহন বাধ্য হয়ে মহাসড়ক ব্যবহার করে। এই কারণে বড় যানবাহনের সাথে ছোট যানবাহনের ভয়াবহ দুর্ঘটনায় অধিক প্রাণহানি ঘটছে। এসব দুর্ঘটনার জন্য কারো শাস্তি হয় না। সড়ক নির্মাণে এলজিইডির বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ। এখানেও সংস্কার করতে হবে।
এতে আরো জানানো হয়, বিদ্যমান বাস্তবতায় সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য রোড সেফটি ফাউন্ডেশন আগামী ৭ ও ৮ ডিসেম্বর দুই দিনব্যাপী একটি জাতীয় সংলাপের আয়োজন করতে যাচ্ছে। এই সংলাপে জাতীয় টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন, সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ পর্যালোচনা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি এবং বিআরটিএ, ডিটিসিএ, বিআরটিসি, সওজ, এলজিইডি-সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে কার্যকারিতা ও জবাদিহিতা নিশ্চিতের কৌশল তৈরি করতে সরকারের নীতি-নির্ধারক, বিশেষজ্ঞ, সড়ক পরিবহনের মালিক-শ্রমিক নেতৃবৃন্দ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করবেন।