জাফর আলম, কক্সবাজার থেকে :
কক্সবাজারে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য ও ককটেলসহ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনী আরসা’র লজিস্টিক শাখার প্রধান রহমত উল্লাসহ তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। বোববার (৩১ ডিসেম্বর) ভোরে সদর উপজেলায় শহরের কলাতলীর ডিসি পাহাড় সংলগ্ন আদর্শগ্রাম এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিস্ফোরক দ্রব্যসহ তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তাররা হলেন, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনী আরসার লজিস্টিক শাখার প্রধান ও উখিয়া ক্যাম্প-৩ এর মৃত আবুল কাশেম এর ছেলে হাফেজ রহমত উল্লাহ (৩৫), ক্যাম্প-৫ এর নুরুল ইসলাম এর ছেলে মনজুর আলম (২৩) এবং একই ক্যাম্পের কামাল হোসেন এর ছেলে নুরুল ইসলাম (২৫)। এসময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৪ দশমিক ৯ কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য, ১৫ পিস ককটেল, ফেক আইডি তৈরীর সরঞ্জাম, ১ দশমিক ৫ কেজি মারকারী, ১টি ওয়াকিটকি, ৫৩টি সার্কিট, ৯ বান্ডিল সামরিক বাহিনীর ন্যায় পোষাক তৈরীর কাপড়, ৭০টি গেঞ্জি, ১২টি টুপি, ১৩০টি হ্যান্ড গ্লোভস, নগদ ২ হাজার ২৯০ টাকা, ২টি মোবাইল এবং ১টি ল্যাপটপ।
বোববার দুপুরে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন র্যাব-১৫ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সিনিয়র সহকারী পরিচালক মোঃ আবু সালাম চৌধুরী। তিনি বলেন, গোপন সংবাদ পেয়ে আজ ভোরে শহরের কলাতলী আদর্শগ্রাম এলাকায় র্যাবের একটি দল সন্দেহজনক একটি বাড়িতে অভিযান চালায়। এসময় সন্ত্রাসী সংগঠন আরসা’র লজিস্টিক কমান্ডার হাফেজ রহমত উল্লাহসহ তিনজন আরসা সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদে র্যাব জানতে পারেন গ্রেপ্তার হাফেজ রহমত উল্লাহ ২০০০ সালে অবৈধ পথে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে এবং টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে বসবাস শুরু করে। সেখানে বসবাস করাকালীন সময়ে হেফজ শেষ করে। এরপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন মেয়াদে হাফেজ, দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত পড়াশুনা করে এবং বার্মিজ, রোহিঙ্গা, বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, আরবী ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠে। পড়াশুনা শেষে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে মায়ানমার গমন এবং মায়ানমারে নিজ জমি-জমা বিক্রি করে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া চলে যায়। ২০১৮ সালে মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে চলে এসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস শুরু করে। একপর্যায়ে বাংলাদেশে অবস্থানকালে ২০১৯ সালে আরসার গান গ্রুপ কমান্ডার মাষ্টার ইউনুছের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মৌলভী রফিকের মাধ্যমে হাফেজ রহমত উল্লাহ আরসায় যোগদান করে। আরসায় যোগদানের পরপরই তাকে মায়ানমারে তসকিলে (ট্রেনিং) এ পাঠানো হয় এবং সেখানে ৪ মাস অবস্থান করে আরসার হয়ে ট্রেনিং সম্পন্ন করে।
হাফেজ রহমত উল্লাহ আরসায় যোগদান করার পর প্রথমে আরসার ওলামা বডির সদস্য হয় এবং বিভিন্ন মসজিদে সাধারণ রোহিঙ্গাদের আরসায় যোগদানের দাওয়াত প্রদান করে আসছিল । এছাড়াও সে আরসার ওলামা বডির সদস্যদের দাওয়াতি ট্রেনিং প্রদান করতো। এর মধ্যদিয়ে বিভিন্ন উপায়ে আরসা প্রধান আতাউল্লাহ এবং সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ওস্তাদ খালেদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং সিগনাল এপ্স এর মাধ্যমে গ্রেফতারকৃত হাফেজ রহমত উল্লাহ তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছিল। আরসার জন্য লজিস্টিক সাপোর্ট, বোমা ও মাইন বানানোর জন্য বিভিন্ন মালামাল সংগ্রহ এবং সরবরাহ করার সুবিধার্থে ওস্তাদ খালেদের নির্দেশে কক্সবাজার শহরে ভাড়ায় বাসা নিয়ে বসবাস শুরু করে। এ সুবাদে সে আরসার জন্য লজিস্টিক সাপোর্ট, বোমা ও মাইন বানানোর জন্য বিভিন্ন মালামাল সরবরাহ করার দায়িত্ব পায় এবং লজিষ্টিক শাখার প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে হাফেজ রহমত উল্লাহ আরও জানান, সে আরসা প্রধান এবং সামরিক শাখার প্রধানের ডিমান্ড অনুয়ায়ী বিভিন্ন উৎস থেকে লজিষ্টিক সরঞ্জামাদি বিশেষ করে আরসার জন্য ইউনিফরম এর কাপড়, শীত বস্ত্র, রেইন কোট, বুট জুতা, মোজা, বেল্ট, ক্যাপ, ব্যাগ এবং বোমা ও মাইন বানানোর জন্য হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মারকারী (পারদ), ফোম, টর্চ লাইট, ব্যাটারী, ব্যাটারীর ক্যাপ, ইলেকট্রিক তার, ইলেকট্রিক ক্লিপ, ছোট টেবিল ঘড়ি, ছোট লাইট, লোহার রড, সিমেন্ট, ছোট লোহা, পাইপ, কাচঁ সহকারে নানান ধরনের বোমা ও মাইন তৈরীর সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করতো এবং কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে তা জমা রাখতো। পরবর্তীতে আরসার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড খালেদের নির্দেশনা অনুয়ায়ী এসব সরঞ্জাম উখিয়া – টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসা’র সদস্যদের কাছে সরবরাহ করে আসছিল।
গ্রেপ্তারকৃত মঞ্জুর আলম ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গা শিবিরে সপরিবারে বসবাস শুরু করে। সে ২০১৯ সাল হতে ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্যাম্পের নাইট গার্ড হিসেবে কাজ করতো। ২০২১ সালের শেষের দিকে আরসা নেতা ইমাম হোসেনের মাধ্যমে আরসায় যোগদান করে আরসার ব্লক জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্ব পান। মঞ্জুর আলম ক্যাম্প-৫ এর বি ব্লকের আরসার ব্লক জিম্মাদার হিসেবে কাজ করে এবং সে ১০ জনের দলনেতা।
অপরদিকে গ্রেপ্তার নুরুল ইসলাম ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা নাগরিক হিসেবে টেকনাফের শামলাপুর হয়ে বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে সপরিবারে বসবাস শুরু করে। সে ২০১৯ সালের শেষের দিকে ৫নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্লক-বি/০৪ এর আরসার ব্লক জিম্মাদার আঃ জলিলের মাধ্যমে আরসায় যোগদান করে। সে ক্যাম্প-৫ এর বি ব্লকের আরসার ব্লক পাহারাদার হিসেবে কাজ করতো।
গ্রেপ্তারকৃত আরসা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান র্যাব-১৫ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সিনিয়র সহকারী পরিচালক আবু সালাম চৌধুরী।