নিজস্ব প্রতিবেদক :
বিভিন্ন গণমাধ্যমে হোটেল রাজমনি ঈশা খাঁর অসামাজিক ও অবৈধ মদ ও মাদক ব্যবসার খবর ছাপার পর মালিকপক্ষ হয়ে উঠেছে আরো বেশি বেপরোয়া। পিতার পথ ধরেই হাঁটছে রাজমণি ঈশা খাঁর মালিক আহসান উল্ল্যাহর মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে, হোটেলের এক মাঝ পর্যায়ের এক হোটেল স্টাফ জানান গতকাল রোববার প্রকাশ্যেই তাদের কাছে বার্তা আসে মালিক কন্যা আয়েশা ঘোষণা দিয়েছেন,‘আগে রাজমনি চলেছে রাজার মাতো, এখন চলবে রাণীর মতো। কারন মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও স্থানীয় পুলিশ সব নিয়ন্ত্রণে।’ এদিকে দেশীয় মদের লাইসেন্সে ভেজাল বিলাতি মদ বিক্রি করে অভিযোগ ওঠায় হোটেলটির নজরদারিতে এখন গুল্ক গোয়েন্দারা।
এসটিএল কূটনৈতিকদের ব্যবহারের জন্য আনা বন্ডেডওয়্যার হাউস সুবিধার মদ কালোবাজারে বিক্রি করে বিগত সাত বছরে সরকারের প্রায় ২৮৩ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে। এদিকে দেশে বন্ড সুবিধার মদে বিশেষ কায়দায় মায়া বড়ি/ঘুমের ওষুধ, ফার্নিচারে স্পিরিট ও অন্যান্য রাসয়নিক মিলিয়ে ভেজাল দিয়ে কালোবাজারে বিক্রি করায় আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে মদ সেবীর সংখ্যা। ভেজাল ও নিম্নমানের মদ পানে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। কারো কারো হারাতে হয়েছে প্রাণও। আর এই ভেজাল মদ কালোবাজারে বিক্রিতে এসেছে রাজমনি ঈশা খাঁ হোটেলের মালিক আহসান উল্ল্যাহ মনির নাম। তথ্য প্রমাণ বলছে বিলাতি মদ আমদানি ও বিক্রির অনুমোদন না থাকা রাজমনি হোটেলের দেশীয় (কেরু এন্ড কোং এর মদ ও যমুনা গ্রুপের ক্রাউন বেভারেজ লি. এর হন্টার বিয়ার) বারে অবাধে বিক্রি হচ্ছে বিলাতি মদের লেবেল সেঁটে বিষাক্ত পানীয়।
অভিযোগ আছে ফ্যাসিস্ট সরকার হিসেবে অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম ডোনার ও বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আহসান উল্ল্যাহ মনি এই আবাসিক হোটেল কাম বারের মালিক হওয়ার সুবাধে মূল দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিয়মিত যাতায়াত করতেন সেখানে। ছিলো পৃথক রাজকিউ স্যুইট আর সেবা দাসি। আর মূল লবির উপরের দুই ফ্লোরে নিয়মিত যাতায়াত ছিলো যুবলীগের ক্যাসিনোকান্ডের গডফাদার সম্রাট ও তার অনুসারীদের।
সম্রাটের এক বান্ধবীর হাত ধরে দোতলার বারে বসা শুরু হয় আধুনিক রাজা-বাদশাদের জলসা ঘর। সুরা আর সাবাবের আমেজ নিতে দিন দিন বাড়তে থাকে ভিড় । আসেন বিগত সরকারের সংসদ সদস্য শাওন, কাউন্সিলর পপি, ক্যাডার আরমান, ছাত্রলীগ (বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত) নেতা মাহমুদ হাসান রিপন ও তার সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ফ্যাসিস্ট সরকারের নেতা কর্মীরা। ক্রমবর্ধমান ভিড়ের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে মদের চাহিদা।
এরই ধারাবাহিকতায়, অধিক মুনাফার লোভ ফরেন লিকারের দাবি ওঠায় শুরু হয় অবৈধ ও ভেজাল মদের ব্যবসা। তবে সরকার বদলের পরও আহসান উল্ল্যাহ মনিরের ভেজাল মদের শুল্ক ফাঁকি দেয়ার দোকান এখনো চালু রয়েছে তার স্ত্রীর নাম ভাঙ্গিয়ে।
সূত্র বলছে, মদ বিক্রির কোম্পানি সাবের ট্রেডার্স লিমিটেড বা এসটিএলে চট্টগ্রামভিত্তিক বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের সঙ্গে পার্টনার ছিলেন এমপি আনার হত্যাকাণ্ডে আলোচিত সোনা ও হীরা চোরাকারবারির ডনখ্যাত দিলীপ কুমার আগরওয়ালা আর এই সিন্ডিকেটের অবৈধ মদ বিক্রির মূল হোতা এখনও আছেন আহসন উল্ল্যাহ মনি।
সূত্র আরো জানায়, বিগত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ক্ষমতার পালাবদলে আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিপন্থি হয়ে ওঠেন দিলীপ কুমার আগরওয়ালা ও মনি সিন্ডিকেট। এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ৭৫ শতাংশ শেয়ার থাকার পরও, মাত্র ২৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক হয়ে দিলীপ রাতের আঁধারে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন পুরো সাবের ট্রেডার্স লিমিটেড। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে কয়েক’শ কোটি টাকার শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা মদের মজুদ রয়েছে বলে জানা গেছে শুল্ক ও আবগারি বিভাগ সূত্রে। এমন পরিস্থিতিতে দিলীপের মদের কোম্পানি সাবের ট্রেডার্সে এনবিআরের নজরদারি বাড়ানোর হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
গত ৪ সেপ্টেম্বর র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হন দিলীপ কুমার আগারওয়ালা। আর তখন থেকেই মনি বনে যান এসটিসিএল এর একক অধিপতি। প্রতি দিনেই হুলুদ প্লেট সম্বলিত একটি এসইউভিতে করে এসটিসিএল থেকে রাজধানীর বারিধারার এক অভিজাত আবাসিক এলাকায় পৌঁছে যায় বিলাতি মদের চালান। সেখানেই প্রক্রিয়াজাত হয়ে সংখ্যায় তিন গুন হয়ে পৌঁছে যায় কাকরাইলের রাজমনি ঈশা খাঁ হোটেলের বারে।
এদিকে চলতি বছরের ২০ জুন রাজধানীর নয়াপল্টনের একটি অফিসকক্ষ থেকে ফরহাদ (২১) ও ইমন (২৩) নামে দুই তরুণের লাশ উদ্ধার করে পল্টন থানা পুলিশ। এই দুজন বিষাক্ত মদ পানের কারণে মারা যেতে পারেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করে পুলিশ। এর আগে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল নওগাঁর মান্দায় বিষাক্ত মদপানের পর অসুস্থ তিন যুবকের মৃত্যু হয়েছে। মৃত যুবকরা হলেন- উপজেলার ভারশো ইউনিয়নের পাকুড়িয়া গ্রামের আক্কাস আলীর ছেলে শারিকুল ইসলাম পিন্টু (২২), পাকুড়িয়া মধ্যপাড়া গ্রামের আবদুর রশিদের ছেলে আশিক হোসেন (২২) ও প্রসাদপুর ইউনিয়নের দারিয়াপুর গ্রামের নেকবর আলীর ছেলে নাঈমুর রহমান নিশাত (২০)।
সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধের (মানস) হিসাব মতে, দেশে বর্তমানে মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। এর মধ্যে ১ কোটি মদসহ অন্যান্য মাদকে আসক্ত এবং বাকি ৫০ লাখ মাঝেমধ্যে মাদক সেবন করে। সেই হিসাবে দেশের প্রায় ১৭ কোটি ১৫ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে গড়ে প্রতি ১২ জনে (১১ দশমিক ৬৭) একজন মাদকসেবী। শতাংশের হিসাবে মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ মাদকসেবী। মাদক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও মাদক পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করায় বাংলাদেশ মাদকের বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ ছাড়া সহজে পাওয়া যাচ্ছে যেকোনো মাদক। ফলে দিন দিন বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মনে করছে, সাম্প্রতিক সময়ে নতুন পথে নতুন মাদকের অনুপ্রবেশ আরও বেশি আসক্ত করে তুলছে তরুণ ও যুবকদের। পাশাপাশি পূর্ণবয়স্ক এবং শিশু-কিশোরদের মধ্যেও মাদকাসক্তি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ থেকে ২০২৩-এর জুলাই পর্যন্ত মাদকাসক্ত হয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে (রিহ্যাব) চিকিৎসা নিতে গেছে অন্তত ৫০ হাজার মাদকসেবী। আর গত পাঁচ বছরে রিহ্যাবে চিকিৎসা নিতে যাওয়া মাদকাসক্ত নারীর সংখ্যা বেড়েছে পাঁচ গুণ। ১৫ ও তার কম বয়সী মাদকাসক্তের সংখ্যা বেড়েছে তিন গুণ।
মানসের চেয়ারম্যান ও জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের উপদেষ্টা সদস্য অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরীর মতে- মাদক হলো সব অপরাধের জনক। খুন, ধর্ষণ, পারিবারিক কলহ থেকে শুরু করে ছিনতাইয়ের মতো ঘটনার বেশির ভাগ ঘটছে মাদকের কারণে। এনবিআর সূত্র বলছে, বর্তমানে সারা দেশে দেড় শতাধিক লাইসেন্স পাওয়া মদের বার রয়েছে। যার ৮০ শতাংশ রাজধানীতে।
এ ছাড়া বন্ড সুবিধায় আসা মদ কূটনৈতিক ব্যক্তিত্বরা (প্রিভিলেজড পারসন) বেশি কেনেন। বিভিন্ন সময়ে মেলা তথ্য বলছে, তারা ওই মদের একটি অংশ বাইরে বিক্রি করে দেন। এ ছাড়া মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি, চোরাইপথেও মদ আসে। এসব মদ সরাসরি যায় দিলীপের মদ বিক্রির কোম্পানি সাবের ট্রেডার্স লিমিটেড বা এসটিএলে সেখান থেকে প্রক্রিয়া হয়ে যায় রাজমনি ঈশা খাঁসহ বেশ কেয়েকটি হোটেল বার ও ক্লাবে।
শুল্ক ফাঁকি আর মদে ভেজালের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমে দেখা গেছে আবাসিক এই হোটেলটির বারের সব ময়লা নিকটবর্তী শান্তিনগর ডাস্টবিনে পরলেও সেখানে খালি কেরু মদের বোতল, বিয়ারের ক্যান ও খাবের উচ্ছিষ্ট থাকলেও নেই বিদেশী কোন মদের বোতল। তথ্য বলছে বারিধারার সেই আবাসিক এলাকায় আবারো ফিরে যায় নতুন মদ আর লেবেল সেঁটে গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে।
এনবিআর সূত্র জানায়, বন্ড সুবিধায় দেশে ছয় ধরনের মদ বা অ্যালকোহল-জাতীয় পানীয় বাংলাদেশে আসে। আমদানি করা মদের মধ্যে রয়েছে- বিয়ার, স্পিরিট জাতীয় পানীয়, হুইস্কি, রাম ও টাফিয়া, গিন ও জেনিভা, ভদকা, লিকারস ও করডিয়ালস। এনবিআরের অধীন কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অফিস শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় থাকা ছয়টি বারে মদের আমদানি ও সরবরাহ দেখভাল করে। এগুলো হলো- সাবের ট্রেডার্স লিমিটেড, ইস্টার্ন ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিসেস, টস বন্ড, ন্যাশনাল ওয়্যারহাউজ, ঢাকা ওয়্যারহাউজ ও এইচ কবির অ্যান্ড কোম্পানি। এর মধ্যে পাঁচটি গুলশানে এবং একটি মহাখালীতে অবস্থিত। ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অফিসের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রিভিলেজড পারসনদের শুল্কমুক্ত সুবিধার সনদ দিয়ে থাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
অভিযোগ রয়েছে, অতীতে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধাপ্রাপ্ত বারগুলো বিপুল পরিমাণ শুল্কমুক্ত মদ এনে বাইরে বিক্রি করে দিত। এতে বারগুলো লাভবান হলেও সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাত। এ খাতে শৃঙ্খলা আনতে ২০১৭ সালে ছয়টি বন্ডেড ওয়্যারহাউজে মদ আমদানি, তা বিক্রির পাস বই সংরক্ষণ; ক্রেতার শুল্কমুক্ত সুবিধার সনদ দেখানো এবং কোন ব্র্যান্ডের কতটুকু বিক্রি হলো তা প্রতি মাসে পাঠানোর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। তবে শুরুর দিকে তা পরিপালন না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে নিরবতা ভেঙেছে এনবিআর।
এনবিআরের কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অফিসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, একজন প্রিভিলেজড পারসন বছরে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মদ শুল্কমুক্ত সুবিধায় গ্রহণ করতে পারেন। এখন প্রতিটি বিক্রির বিপরীতে পাস বইয়ের কপি ও শুল্কমুক্ত সুবিধার কপি জমা নেয়া হচ্ছে প্রতি মাসে। ফলে অনিয়ম করে বাড়তি আমদানির সুযোগ কমে গেছে। এসব অভিযোগে বিষয়ে জানতে এসটিএলের দায়িত্বশীল কাউকেই পাওয়া যায়নি। আর গ্রাহকদের বিল ও ভ্যাট চালান না দিয়ে শুল্ক ফাঁকির দায় নিতে নারাজ ঈশা খাঁর ম্যানেজার মনির।