নিজস্ব প্রতিবেদক :
নির্ধারিত সময়ে বীজ আলু সংরক্ষণের জন্য ৪টি নতুন হিমাগার নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেনি বিএডিসি। দুটি হিমাগারের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ কাজ ৮০ শতাংশ শেষ হলেও দুটির কাজ ৩০ শতাংশের মতো। এছাড়া আরো দুটি পুরানো হিমাগার সংস্কার কাজও শেষ হয়নি। একটির সংস্কার কাজ আতুড় ঘরেই রয়েছে। এসব কারণে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে প্রকল্পের কাজেরও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩৯ কোটি টাকা। সংস্থাটির মনিটরিং বিভাগের গঠিত একটি কমিটি দায়সারা পরিদর্শন প্রতিবেদন দিলেও তাতে প্রকল্পের কাজ ‘সন্তোষজনক নয়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এদিকে হিমাগারগুলোর নির্মাণ ও সংস্কার কাজ শেষ না হওয়ায় প্রয়োজনীয় বীজআলু সংরক্ষণ করতে পারছে না বিএডিসি। চলতি বছরেও বাড়তি অন্তত ১৪ হাজার টন বীজ আলু সংরক্ষণের লক্ষ্য ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ফলে সরকারের ভিশন বীজ আলু সংরক্ষণের মাধ্যমে টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিঘ্নিত হতে পারে।
নথিপত্র ঘেঁটে ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বীজআলু সংরক্ষণ ক্ষমতা, রোগমুক্ত উন্নতমানের আধুনিক জাতের বীজ আলুর উৎপাদন বাড়ানো এবং কৃষকদের মাঝে মানসম্পন্ন বীজ আলু সরবরাহের লক্ষ্যে ‘মানসম্পন্ন বীজ আলু উৎপাদন ও সংরক্ষণ এবং কৃষক পর্যায়ে বিতরণ জোরদারকরণ প্রকল্প’ নেয় সরকার। সেপ্টেম্বর ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৫ বছর মেয়াদী এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় ৬শ ৮৮ কোটি ২১ লাখ ১২ হাজার টাকা। তবে নির্ধারিত মেয়াদে কাজ শেষ না হওয়ায় সেপ্টেম্বর থেকে আগামী বছরের (২০২৫) জুন পর্যন্ত আরো এক বছরের মেয়াদ বাড়ানো হয়। প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৭শ ২৭ কোটি ৪২ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। প্রকল্পের আওতায় জয়পুরহাট সদর, নীলফামারী সদর, দিনাজপুরের নশিপুর ও রংপুর সদরে ২ হাজার টন করে ৮ হাজার টন ধারণক্ষমতার যান্ত্রিকীকরণসহ নতুন হিমাগার নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর মালতি ও ডোমারের পুরানো হিমাগার মেকানাইজেশনসহ সংস্কার কাজ করা হচ্ছে। ডিপিপিতে ম্যানুয়াল হিমাগার নির্মাণের কথা বলা হলেও পরে সংশোধিত ডিপিপিতে হিমাগার ম্যাকানাইজেশন বা যান্ত্রিকীকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়। মেয়াদের মেষ সময়ে এসে নকশা বা পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনায় প্রকল্পের কাজ আরো থমকে যায়।
মালতি হিমাগার সংস্কার কাজে ৩৩ কোটি ৭১ লাখ ৭৩ হাজার টাকা ও ডোমারের হিমাগার সংস্কার কাজে ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ কোটি ৭৪ লাখ ২৭ হাজার টাকা। প্রকল্পের আওতায় জমি অধিগ্রহণ, জমি উন্নয়ন (মাটি ভরাট), প্রশিক্ষণ, ভ্রমণ, বিভিন্ন হিমাগারের প্রাচীর নির্মাণ, আসবাবপত্র, কম্পিউটার, গাড়ি, বীজআলু আমদানী, বস্তা, ত্রিপল কেনাসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম কেনাকাটাও রয়েছে। কিন্তু যথাযথ তদারকির অভাব ও অদক্ষতার কারণে প্রকল্পের কাজ চলছে ধীর গতিতে। গেল সেপ্টেম্বরে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) আবীর হোসেনের তৈরি করা প্রতিবেদনে প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৮০ শতাংশ উল্লেখ করা হয়েছে। বিএডিসির মনিটরিং বিভাগের একটি গঠিত প্রকল্প কার্যক্রম পরিদর্শন কমিটি চলতি বছরের মে মাসে প্রতিবেদন দেয় সংস্থাটির চেয়ারম্যানকে। যুগ্ম নিয়ন্ত্রক (অডিট) মোহাম্মদ ইমাম হোসেন ও সহকারী প্রধান প্রকৌশলী (সওকা) মাজুদ আলম স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দিনাজপুরের হিমাগার ছাড়া বাকি হিমাগারগুলোর ভৌত কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। আর কোনো বিস্তারিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। তবে অন্যান্য কাজের অগ্রগতির কথা প্রকল্প কার্যালয় থেকে সরবরাহ করা তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কার্যাদেশ অনুযায়ী হিমাগার নির্মাণের সময়সীমা অতিক্রান্ত হয়েছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় তদারকি অফিসের সঙ্গে সমন্বয় এবং কাজ দ্রুত করার তাগিদ দিতে হবে। তবে বিএডিসির চেয়ারম্যান এই পরিদর্শন প্রতিবেদন সম্পর্কে অবগত নয়, তা চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে বলে সূত্র দাবি করছে। চলতি বছরেও একটি পরিদর্শন কমিটি করা হলেও এখন পর্যন্ত কমিটি প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেনি বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বিএডিসির সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রংপুর ও নীলফামারীর নতুন হিমাগার নির্মাণ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৩০ শতাংশের বেশি হয়নি। ডোমারে পুরানো হিমাগার সংস্কার কাজে একটি নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে আর কোনো কাজ হয়নি। তবে ইতিমধ্যে (জুন পর্যন্ত) ৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদনে। একই অবস্থা মালতি হিমাগার সংস্কার কাজেও। তবে ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় ২১ কোটি টাকা। আর নতুন হিমাগারের মেশিনারীসহ নির্মাণ কাজে চলতি অর্থ বছরে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। প্রকল্পের আওতায় শুধু ৫৩ হেক্টর ভ’মি উন্নন কাজে ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা। কৃষি যন্ত্রপাতি ৪৫২টির মধ্যে ৪২৩টি কেনা দেখানো হয়েছে। সাড়ে ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পুরানো দুইটি হিমাগারে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল স্থাপন কাজ সম্পন্ন দেখানো হলেও খোঁজ নিয়ে তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। যা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রকল্পের ভৌত কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক না হলেও বোধগম্য কারণে কেনাকাটা প্রায় সম্পন্ন করেছেন পিডি। যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
সূত্র জানায়, বিতর্কিত কর্মকর্তা আবীর হোসেন একই সঙ্গে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। ‘মানসম্পন্ন বীজ আলু উৎপাদন ও সংরক্ষণ এবং কৃষক পর্যায়ে বিতরণ জোরদারকরণ প্রকল্প’র পিডির পাশাপাশি আবীর হোসেন বিএডিসির গুরুত্বপূর্ণ বীজ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) হিসেবে চলতি দায়িত্ব পালন করছেন প্রায় এক বছর ধরে। অভিযোগ উঠেছে, তিনি এখন বিভাগটির পূর্ণ দায়িত্ব পাওয়ার জন্য চেষ্টা-তদবির চালাচ্ছেন। প্রকল্পের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তিনি সরে যেতে চাইছেন। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) বিধি লঙ্ঘন করে আবীর হোসেন শুরুতেই ‘মানসম্পন্ন বীজ আলু উৎপাদন ও সংরক্ষণ এবং কৃষক পর্যায়ে বিতরণ জোরদারকরণ প্রকল্পে’র পিডি পদটি বাগিয়ে নিয়েছিলেন। ডিপিপিতে পিডি পদটি তৃতীয় গ্রেডের হলেও আবীর ছিলেন চতুর্থ গ্রেডের কর্মকর্তা। যোগ্য ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা থাকলেও বিএডিসির তৎকালীন চেয়ারম্যাান সায়েদুল ইসলাম ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাককে বিশেষভাবে ম্যানেজ করে কনিষ্ঠ এই কর্মকর্তা অবৈধভাবে পদটি বাগিয়ে নেন। দাপটের সঙ্গে এতোদিন দাপিয়ে বেড়ালেও সরকারের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আবীর হোসেন ভোল পাল্টে ফেলেছেন। এজন্য বিভিন্ন জায়গায় মোটা অংকের অর্থও ঢেলেছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, পিডি হিসাবে আবীর হোসেন প্রকল্পের একটি গাড়ি এবং জিএম (বীজ) হিসাবে বিভাগটির একটি গাড়ি ব্যবহার করছেন। একটি গাড়ি সার্বক্ষণিক তার পরিবারের সদস্যদের দিয়ে রেখেছেন তিনি, যা অনৈতিক।
এব্যাপারে মানসম্পন্ন বীজ আলু উৎপাদন ও সংরক্ষণ এবং কৃষক পর্যায়ে বিতরণ জোরদারকরণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. আবীর হোসেন দাবি করছেন, হিমাগার নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে। সামনের মৌসুম থেকেই বীজআলু সংরক্ষণ করা যাবে। দুইটি গাড়ি তিনি ব্যবহার করছেন না। সরকার জেনেশুন্বেি তাকে পিডি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে, যদিও বিষয়টি পুরানো হয়ে গেছে।