নিজস্ব প্রতিবেদক :
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিশু আয়ানের মৃত্যু প্রতিবেদন নিয়ে শুনানিতে হাইকোর্ট বলেছেন, শুধু বাংলাদেশেই নয়- সারা বিশ্বে মেডিকেল সেক্টরে মাফিয়া চক্র কাজ করে। তারা ওষুধসহ মেডিকেল উপকরণ সরবরাহে রি-এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে সবার সচেতন হওয়া প্রয়োজন। শুধু আদেশ দিলাম, পত্রিকায় নাম আসল এটা আমরা চাই না। ১৮ কোটি মানুষের উপকার হবে এমন কিছু করতে চাই।
রোববার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় রিটের শুনানিতে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ এসব কথা বলেন।
আদালত এ মামলায় পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী মঙ্গলবার দিন ধার্য করেছেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। তার সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সেলিম আজাদ। রিটের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট এবিএম শাহজাহান আকন্দ মাসুম।
এ ছাড়া এই মামলায় দেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে তথ্য ও আইন তুলে ধরার জন্য অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনিরকে ইন্টারভেনর হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন হাইকোর্ট।
উল্লেখ্য, রাজধানীর একটি বেসরকারি স্কুলের নার্সারি শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল আয়ান। গত ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর বাড্ডার সাতারকুল ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুন্নতে খতনার জন্য অজ্ঞান করা হয় তাকে। এরপর জ্ঞান না ফেরায় তাকে সেখান থেকে নেওয়া হয় ইউনাইটেড হাসপাতালের গুলশান শাখায়। সেখানে টানা ৭ দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর শিশু আয়ানের মৃত্যু হয়।
পরবর্তীতে অনুমতি ছাড়াই শিশু আয়ানের খতনা করানো হয় বলে অভিযোগ তুলেন তার বাবা শামিম আহমেদ। তিনি বলেন, হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার কারণে তার সন্তানের মৃত্যু হয়েছে।
ওই ঘটনায় হাইকোর্টের নজরে এলে সাত দিনের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়। ২৮ জানুয়ারি আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষে উপ-পরিচালক (আইন) ডা. পরিমল কুমার পাল ১৫ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে দেখা যায়, তদন্ত কমিটি বলেছে, ৫ বছর ৮ মাস বয়সী আয়ানের ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা (হাঁপানি) ছিল। এই বয়সে অটো পিক বা অ্যালার্জিক অ্যাজমা হয়ে থাকে। ব্রঙ্কিায়াল অ্যাজমা অ্যালার্জেন (অতি সংবেদনশীলকারক) দিয়ে হয়।
অস্ত্রোপচারের আগে আয়ানকে অ্যানেস্থেসিয়া বা সংবেদনহীন করতে প্রয়োগ করা ইনজেকশন প্রোফোফল মারাত্মক অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া (অ্যানাফিল্যাকটয়েড রিয়্যাকশন) সৃষ্টি করতে পারে। যার ফলে শ্বাসতন্ত্র সংকুচিত হয়ে (ল্যারিঙ্গো স্পাজম) বা (ব্রঙ্কোস্পাজম) শ্বাসনালীর আশপাশের পেশি শক্ত হয়ে খিঁচুনি হয়ে থাকতে পারে। যা অ্যানেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ ম্যানেজ করেছেন।
চার নম্বর মতামতে বলা হয়েছে, সিপিআর (কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন) ও ওষুধ (মেডিকেশন) দিয়ে আয়ানের হৃদস্পন্দন ফিরিয়ে আনতে ১০ মিনিটের মতো সময় লেগেছিল। যার কারণে হাইপক্সিক ব্রেন ইনজুরি (মস্তিষ্কে অক্সিজেন প্রবাহ বন্ধ হয়ে মৃত্যু) হয়ে আয়ানের মৃত্যু হতে পারে। তখন সিটি স্ক্যান বা ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাম-ইসিজি করলে হাইপক্সিক ব্রেন ইনজুরি হয়েছিল কি না, তা জানা যেত। তাছাড়া সিপিআরের কারণে (রিব ফ্র্যাকচার) পাঁজরের হাড়ও ভেঙে যেতে পারে বলেও মতামতে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে আরও বলা হয়, সিপিআর একটি জীবনদায়ী পদ্ধতি। মানুষের হৃদযন্ত্র ও শ্বাসযন্ত্রের কাজ বন্ধ হয়ে গেলে দুই হাতে বুকে চাপ দিয়ে শরীরে রক্ত ও অক্সিজেন চলাচল স্বাভাবিক করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আয়ান চাইল্ডহুড অ্যাজমা সমস্যায় ভুগছিল। শ্বাসকষ্টের জন্য আয়ানকে মাঝে মাঝে নেবুলাইজার ও ইনহেলার দেওয়া লাগতো। সুন্নতে খৎনার অপারেশনের আগে ওয়েটিং রুমে তাকে নেবুলাইজার ও ইনহেলার দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়টি চিকিৎসকদের জানানো হয়নি।
প্রতিবেদনের মতামত অংশে আরও বলা হয়, শিশু আয়ানের অপারেশনের সময় স্বাভাবিক রক্তপাত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
পরবর্তীতে ২৯ জানুয়ারি এ নিয়ে শুনানিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আইওয়াশ (লোক দেখানো) ও হাস্যকর বলে মন্তব্য করেন বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ।
সেদিন আদালত বলেন, দায় এড়ানোর জন্যই তারা (তদন্ত কমিটি) এ ধরনের রিপোর্ট দাখিল করেছে। শিশু আয়ানের অ্যাজমা সমস্যা থাকার কথা জানার পরও কেন চিকিৎসকেরা অপারেশনের জন্য এত তাড়াহুড়া করলেন? ওই সময় সুন্নতে খতনা করার সময় যে পরিমাণ ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে, হার্টের বাইপাসেও এত ওষুধ লাগে না বলেও মন্তব্য করেন আদালত।
ওই দিন প্রতিবেদনটি আদালতে তুলে ধরেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সেলিম আজাদ। রিটের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট এবিএম শাহজাহান আকন্দ মাসুম।