বগুড়া প্রতিনিধি :
কথা ছিল সরকার পতন হলে বাড়ি ফিরবে। সরকারের পতন হলো। বিজয় মিছিল থেকে সোহেল ফিরলেন লাশ হয়ে।
বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার ভাটরা গ্রামের দিন মজুর ফেরদৌস প্রামাণিকের ছেলে সোহেল রানা। কাজ করতেন ঢাকার একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানে। গত জুলাই থেকে শুরু হওয়া বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন সোহেল।
স্বামীর মৃত্যু এবং অনাগত সন্তানের ভবিষ্যত ভাবনায় দিশেহারা সোহেলের সন্তান সম্ভবা স্ত্রী সাম্মি আখতার। ‘সোহেলকে বলেছিলাম, তুমি বাড়ি ফিরে এসো। উত্তরে সোহেল বলেছিল, শেখ হাসিনার যেদিন পতন হবে সেই দিনই বাড়ি ফিরব।’ সাম্মি আখতারের হৃদয় বিদারি আহাজারি, ‘হাসিনার পতন হলো। সন্তানের মুখ দেখা হলো না সোহেলের।’
সরেজমিনে সোহেল রানার গ্রামের বাড়িতে দেখা যায়, বারান্দায় বসে সোহেলের অনাগত সন্তানের জন্য কাঁথা সেলাই করছেন সোহেলের মা মাবিয়া বেগম। পাশে সোহেলের ব্যবহৃত একটি চামড়ার ব্যাগ। প্রতিবেদককে দেখেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মাবিয়া- ‘ছেলের মুখ দেখলো না আমার বাবা। ব্যাগ তেমনই আছে। আমার বাবা ফিরলো লাশ হয়ে।’
জুলাই মাসের প্রথম দিকে শুরু হওয়া ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমেই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রূপ নেয়। পরে তা সহিংস হয়ে উঠলে ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও এতে অংশ নেন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার এই আন্দোলন পরে এক দফা দাবিতে পরিণত হয়। যার ফলশ্রুতিতে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অপতিরোধ্য আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন সাবেক প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিন স্বত:স্ফুর্ত ছাত্র-জনতা সারাদেশ থেকে বিজয় মিছিল নিয়ে গণভবনের দিকে যাত্রা করে। যাত্রাবাড়ি থেকে গণভবনের পথে এমনই এক মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন সোহেল রানা।
জানা যায়, ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবরে বিজয় মিছিলে যোগ দেন সোহেল। রাজধানীর যাত্রবাড়ি এলাকা থেকে গণভবন মুখি মিছিলে ছাত্র-জনতার সাথে যাওয়ার সময় অতর্কিত হামলা ও গোলগুলিতে গুলিবিদ্ধ হন সোহেল। সেখান থেকে তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। এরপরই ঢাকায় অবস্থানরত সোহেলের এক চাচাতো ভাই আবুল হাসনাত লেমনের কাছে সোহেলের মোবাইল থেকে ফোন আসে।
হাসনাত জানান, কোন এক অজ্ঞাত ব্যাক্তি সোহেলের মোবাইল থেকে ফোন করে বলেন, ‘আপনার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। ঢাকা মেডিকেলে আছেন। তার লাশ নিয়ে যান। কাঁন্নাকাটি করবেন না।’ ফোন পেয়ে লেমন দৌড়ে যান ঢাকা মেডিকেলে। সেখানেই মর্গে গিয়ে দেখেন সোহেলের নিথর দেহ মেঝেতে পড়ে আছে।
সোহেলের বাবা দিন মজুর ফেরদৌস প্রামাণিক জানান, তার দুই ছেলে। সোহেল ছোট বেলা থেকেই লেখা-পড়ায় আগ্রহী ছিলো। বড় ছেলে সিহাব প্রামাণিক পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সোহেলের ওপরই ছিলো পরিবারের দায়-দায়িত্ব। দারিদ্র্যের কারণে সংসারের হাল ধরতে ২০২৩ সালে বগুড়া থেকে ঢাকায় যায় কাজের সন্ধানে। ঢাকায় একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানে চাকরির পাশাপাশি লেখা-পড়া চালিয়ে যেতে থাকে। এর পর স্নাতকোত্তর পাশ করেন। সোহেলের স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা করে ভাল চাকারি করবেন। পুরণ হলো না তার স্বপ্ন।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তিকে হারিয়ে দিশেহারা পরিবার। ঢাকায় চাকরি ও লেখাপড়া করে পরিবারের প্রতিও যথাযথ দায়ত্বশীল ছিলেন সোহেল। তার উপার্জিত অর্থেই সংসারের ব্যায়ভার বহন হতো। অনাগত সন্তান নিয়ে তার ছিলো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। সেই উচ্ছসিত আনন্দ ম্লান করে এখন পরিবারে চলেছে শোকের মাতম।
সোহেলের বড় ভাই সিহাব প্রামাণিক এই প্রতিবেদককে জানান, সোহেলের পরিবারকে জামায়াতে ইসলামের পক্ষ থেকে ১ লাখ ও বিএনপি’র পক্ষ থেকে ১৫ হ্জাার টাকা সহযোগিতা করা হয়েছে।