ডেস্ক রিপোর্ট :
দেশজুড়ে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে কক্সবাজারের টেকনাফের চারজন এবং চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে এক শিশুসহ মোট ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। একইসঙ্গে রাজধানীসহ সারাদেশে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। তবে দেশের অনেক এলাকায় ব্যাপক গাছপালা ভেঙে পড়েছে। অনেক জায়গায় বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে গেছে। জমির পাকা, আধাপাকা আমন ধানের ক্ষতি হয়েছে।
শুক্রবার (১৭ নভেম্বর) সকাল থেকে দিনভর কোথাও গুঁড়িগুঁড়ি আবার কোথাও মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন সড়কে গোড়ালি থেকে হাঁটু পরিমাণ পর্যন্ত পানি দেখা গেছে।
টেকনাফে ঘরের মাটির দেয়াল ধসে মা ও ছেলে-মেয়েসহ চারজন নিহত
টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, কক্সবাজারের টেকনাফের হ্নীলায় বসতঘরের মাটির দেয়াল চাপায় এক পরিবারের মা, তিন ছেলে-মেয়েসহ চারজন নিহত হয়েছেন। নিহত চারজন হলেন-উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজারের মরিচ্যাঘোনার পানিরছড়া মৃত ঠান্ডা মিয়ার ছেলে ফকির মোহাম্মদের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৫০), ছেলে শাহিদুল মোস্তফা (২০),মেয়ে নিলুফা ইয়াছমিন (১৫) ও সাদিয়া বেগম (১১)।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাত ৩টার দিকে টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজারের মরিচ্যাঘোনার পানিরছড়া নামক এলাকায় এ ঘটনাটি ঘটেছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপির) চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বৈরী আবহাওয়ার কারণে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হলেও রাত আটটার পর থেকে কয়েক দফা ভারী ও মাঝারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। এতে হ্নীলা ইউনিয়নের মৌলভীবাজারের মরিচ্যাঘোনার পানিরছড়া এলাকায় বসতঘরের মাটির দেওয়াল চাপা পড়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারি এক পরিবারের ৪জন নিহত হয়েছেন।পরে খবর পেয়ে স্থানীয় লোকজন মাটি চাপাপড়া ৪জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।ঘটনার ব্যাপারে পুলিশ ও স্থানীয় ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে খবর দেওয়া হয়েছে।
রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, ফকির মোহাম্মদ নিজে বসতঘরটি মাটি দিয়ে তৈরী করেছিলেন। রাতে ভারী বৃষ্টি হওয়ায় ঘরের উপরে ও চারিপাশে ত্রিপল দিয়ে ঘুমান সবাই।এরপর হঠাৎ রাত ৩টার দিকে ভারী বৃষ্টিতে মাটির দেওয়াল ধসে চাপা পড়ে ফকির মোহাম্মদ ছাড়া বাড়ির সবাই মারা যান।
১নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য বশির আহমদ বলেন, রাতে পরিবার সবাই খাওয়াধাওয়া করে ঘুমাতে যান।এরমধ্যে মধ্যরাতে বসতঘরের মাটির দেওয়াল চাপাপড়ে এক পরিবারের চারজন মারা গেছে। পরে স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় লাশগুলো উদ্ধার করা হয়।
খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী ঘটনা স্থলে ছুটে গিয়ে তাদের উদ্ধারের সহযোগিতা করেন এবং নগদ অর্থ ও চাল বিতরণ করেন।
মৃতদের প্রতি শোক জানান তিনি আমার এলাকায় এরকম ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি, পাশাপাশি আমার পক্ষ থেকে তাদের জন্য দাপন -কাপন সহ সব ধরনের ব্যবস্থার জন্য সহযোগিতা করছি।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আদনান চৌধুরী জানান, আমরা খবর শুনে তাদের দাপন কাপনের জন্য প্রথমিক ভাবে আজকে নগদ ৫ হাজার টাকা দিয়েছি। পরে আরো ২০ হাজার টাকা দেওয়া হবে।
মিরসরাই (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র প্রভাবে সৃষ্ট দমকা বাতাসে গাছ পড়ে সিদরাতুল মুনতাহা আরিয়া (৪) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
শুক্রবার বিকেল ৫টার দিকে উপজেলার ৩ নম্বর জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ সোনাপাহাড় কাটাবিল এলাকার হাসমত আলী ভূঁইয়া বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। নিহত মুনতাহা ওই বাড়ির আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়ার মেয়ে।
মুনতাহার চাচা মোহাম্মদ ফারুক হোসেন বলেন, সবার অগোচরে বিকেলে বাড়ির সামনে গেলে একটি গাছ পড়ে আমার ভাতিজি গুরুতর আহত হয়। দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এদিকে দমকা ঝোড়ো বাতাসে উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও দুই পৌর এলাকায় ব্যাপক গাছপালা ভেঙে পড়েছে। অনেক জায়গায় বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে গেছে। জমির পাকা, আধাপাকা আমন ধানের ক্ষতি হয়েছে।
বৃহম্পতিবার (১৬ নভেম্বর) রাত থেকে পুরো উপজেলায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে জনসাধারণকে। বিদ্যুতের কারণে বাসাবাড়িতে পানি না থাকায় কষ্ট রয়েছে মানুষ।
সন্দ্বীপ প্রতিনিধি জানান, আবদুল ওহাব (৬০) নামে এক ব্যক্তি নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে প্যালিশ্যার বাজারের পূর্ব পাশে রাস্তায় একটি গাছের ডাল ভেঙে তার মাথার ওপর পড়ে। উপস্থিত লোকজন তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়ার পথে বিকেল সাড়ে ৪টায় তার মৃত্যু হয়। নিহত আব্দুল ওহাব মগধরা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তার বাবার নাম আব্দুল লতিফ।
শরীয়তপুর প্রতিনিধি জানান, ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়ো বাতাসে একটি গাছ উপড়ে গিয়ে জুলেখা বেগম নামে এক বৃদ্ধার ওপর পড়ায় বৃদ্ধা ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। শুক্রবার বিকেলে শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার নাগেরপাড়া ইউনিয়নের বালিকুড়ি গ্রামে এই ঘটনা ঘটে। নিহত জুলেখা বেগম (৬৫) একই এলকার মৃত সাত্তার আলী বেপারীর স্ত্রী।
নাগেরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক বলেন, ঘটনাস্থলে আমি গিয়েছিলাম। বৃদ্ধা জুলেখা বেগমের বাড়ির পাশের স্কুলের একটি গাছ বাতাসে পড়ে গিয়েছিল। ওই গাছের নিচে বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। শেষ বয়সে একজন মানুষের এভাবে মৃত্যু স্বজনদের কষ্ট দিচ্ছে। দুর্যোগের সময় মানুষের সতর্ক থাকা উচিত। কেননা প্রাণের চেয়ে মূল্যবান কিছুই নেই।
গোসাইরহাট থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পুষ্পেন দেবনাথ বলেন, বিকেলে ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসে একটি গাছ পড়ে গিয়ে এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। জুলেখা নামের ওই বৃদ্ধার মরদেহ ময়নাতদন্তের পর তার পরিবারকে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। এঘটনায় অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে দমকা হাওয়ায় গাছের ডাল ভেঙে পড়ে এক কাপড় ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে।
শুক্রবার দুপুরে উপজেলা পরিষদ গেইটের সামনে এ ঘটনা ঘটে বলে বাসাইলের ইউএনও পাপিয়া আক্তার জানান। নিহত আব্দুর রাজ্জাক (৪০) উপজেলার মিরিকপুর গ্রামের কুসুম মিয়ার ছেলে।
তিনি বাসাইল বাজারের কোটিপতি মার্কেটে কাপড়ের ব্যবসা করতেন।স্থানীয়দের বরাত দিয়ে ইউএনও জানান, আব্দুর রাজ্জাক উপজেলা জামে মসজিদে জুমার নামাজ শেষে মোটরসাইকেলে বাসায় ফিরছিলেন। উপজেলা পরিষদ গেইটের সামনে পৌঁছলে দমকা বাতাসে একটি মেহগনি গাছের ডাল ভেঙে তার মাথায় পড়ে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন।
পরে স্থানীয়রা উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির চিকিৎসক নাঈম আব্দুল্লাহ বলেন, হাসপাতালে আনার আগেই আব্দুর রাজ্জাক মারা যান। স্বজনরা এসে তার লাশ নিয়ে গেছে।
মনপুরা (ভোলা) প্রতিনিধি জানান, ভোলার মনপুরা উপকূল ঘূর্ণিঝড় মধিলির প্রভাবে রাত থকে ঝড়ো বৃষ্টি হচ্ছে। মনপুরায় লক্ষাধকি মানুষ ঘূর্ণিঝড় মিধিলি আতঙ্কে রয়েছেন। মেঘনা নদী উত্তাল ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলায় মনপুরার সাথে ভোলা ও ঢাকার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌপথে সকল লঞ্চ সার্ভিস বন্ধ করে দিয়েছে উপজলা প্রশাসন। এতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এই উপকূলের লক্ষাধিক বাসিন্দা।
মোংলা প্রতিনিধি জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’ ধেয়ে আসছে উপকূলের দিকে। মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে সাত নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছেন মোংলা শরণখোলা, ও মোরেলগঞ্জের উপকূল এলাকার বাসিন্দারা। সকাল থেকেই মোংলা উপজেলা প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবকরা স্থানীয়দের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে মাইকিং করছেন।
শুক্রবার সকাল থেকে বৃষ্টির সঙ্গে ঝোড়ো বাতাস অব্যাহত ছিল। নদনদীতে স্বাভাবিকের চেয়ে এক থেকে দুই ফুট পানির উচ্চতা বেড়েছে।