মঙ্গলবার , ২৯ জুলাই ২০২৫ | ৩রা আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
  1. অপরাধ
  2. অপরাধচিত্র বিশেষ
  3. অর্থনীতি
  4. আইন-আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. খুলনা
  7. খেলাধুলা
  8. চট্রগ্রাম
  9. জাতীয়
  10. জেলার খবর
  11. ঢাকা
  12. তথ্য-প্রযুক্তি
  13. প্রবাসের কথা
  14. বরিশাল
  15. বিনোদন

রেড ক্রিসেন্টে অস্থিরতা, অনিয়ম ও সাংগঠনিক অদক্ষতার অভিযোগ চেয়ারম্যান ডা. মোঃ আজিজুল ইসলামের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট

প্রতিবেদক
Newsdesk
জুলাই ২৯, ২০২৫ ৭:১৯ অপরাহ্ণ

অপরাধচিত্র প্রতিবেদক :

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি অভ্যন্তরীণ অনিয়ম, দায়িত্বহীন নেতৃত্ব ও মূল্যবোধহীনতার কঠিন বাস্তবতায় নিমজ্জিত। এই অস্থিরতার কেন্দ্রে রয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. মোঃ আজিজুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি, অযোগ্যতা এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ফলস্বরূপ, একটি মানবিক প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিগ্রস্ত, ভয়ভীতিপূর্ণ ও দমনমূলক ব্যবস্থাপনায় পরিণত হয়েছে।

৫ মার্চ ২০২৫ তারিখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুসারে ছয় মাসের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার পর থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক গুরুতর অভিযোগ দৃশ্যমান, যার মধ্যে রয়েছে গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন, প্রশাসনিক অব্যবস্থা, দুর্নীতি, স্বচ্ছতার অভাব এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব।

চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটির নিরপেক্ষতা, মানবিক মূল্যবোধ এবং অন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। রেড ক্রিসেন্ট আজ আর একটি মানবিক সংস্থা নয়, বরং এখন তা পতিত আওয়ামী সরকারের দলীয় নিয়ন্ত্রণাধীন, নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিজবুত তাহরিরের প্রভাব এবং দুর্নীতিগ্রস্ত অবকাঠামোর অংশে পরিণত হয়েছে। এই অবস্থায় চেয়ারম্যানের নৈতিক অবস্থান ও নেতৃত্বের বৈধতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে।

চেয়ারম্যানের কর্তৃত্ববাদী শাসন সাংগঠনিক বিধিভঙ্গ

চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. মোঃ আজিজুল ইসলাম দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে মানবসম্পদ, নিয়োগ, বদলি এবং নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গভর্নিং বোর্ড ও প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে একক ক্ষমতা প্রয়োগ শুরু করেন। সোসাইটির নীতিমালা অনুযায়ী মহাসচিবের নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়ার কথা থাকলেও, তিনি তার ঘনিষ্ঠ মহল-ব্যক্তিগত সহকারী সোহাগ মিয়া, উপ মহাসচিব সুলতান আহমেদ, ডা. শাহানা জাফর ও বোর্ড সদস্য ডা. শেখ আবু জাফর-কে নিয়ে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন এবং পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে নেন।

এই অতি-কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার কাঠামো রেড ক্রিসেন্টের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ভারসাম্যকে ধ্বংস করে দেয়। এক সময়কার নিরপেক্ষ ও মানবিক প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক পুনর্বাসনের কেন্দ্র ও দুর্নীতির আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। বিশেষ করে আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সুবিধাজনক পদে বসানো হয়, যা প্রতিষ্ঠানের পেশাদারীত্ব ও নিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে যায়।

বোর্ডের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে একের পর এক বিতর্কিত নিয়োগ ও বদলির আদেশ জারি করা হয়, এমনকি পূর্বে বাতিল হওয়া কর্মকর্তদের পুনর্বহাল করে সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করা হয় মানবসম্পদ এবং অর্থ বিভাগকে ব্যবহার করে নিয়োগ বাঞ্জি চালানো হয়, যেখানে ন্যূনতম স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা বা প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ার কোনো অস্তিত্ব ছিল না।

চেয়ারম্যানের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত এই সিন্ডিকেট নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি এবং প্রকল্প তহবিল বণ্টনের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে। সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন:

সুলতান আহমেদ, উপ-মহাসচিব যিনি মিথ্যা তথ্য ও জাল জীবনবৃত্তান্তের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত;

সোহাগ মিয়া, ঝক্তিগত সহকারী যিনি চেয়ারম্যানের প্রাইভেট চেম্বারের কর্মচারী থেকে বেআইনি প্রভাব খাটিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছেন;

ডা. শাহানা জাফর যিনি স্বাস্থ্য সেবা এবং তহবিল সংগ্রহ বিভাগের নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন;

ডা. শেখ আবু জাফর, বোর্ড সদস্য যিনি অনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে চেয়ারম্যানকে অবৈধভাবে প্রভাবিত করছেন।

এই সিন্ডিকেট টিকিয়ে রাখতে প্রতিষ্ঠানের ভেতরে যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবাদ কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে। উপ-মহাসচিব সুলতান আহমেদের নিয়োগের বিরুদ্ধে কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে গণস্বাক্ষরসহ প্রতিবাদ জানানো হলেও কোনো বাবস্থা না নিয়ে বরং প্রতিবাদকারীদের বদলি, পদচ্যুতি এবং নানাবিধ হয়রানির শিকার করা হয়েছে।

আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তাকর্মচারীদের পুনর্বহাল বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ

চেয়ারম্যানের প্রশ্রয়ে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা ঢাকায় পদে বহাল থাকার বিনিময়ে বিপুল অর্থ প্রদান করছেন। বোর্ডের মত উপেক্ষা করে নিয়মিত বদলি আদেশ জারি হওয়ায় প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়েছে। জেলা পর্যায় থেকে দলীয় আনুগত্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের ঢাকায় এনে রেড ক্রিসেন্টকে রাজনৈতিক পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে। এই বদলিতে পিএস সোহাগ মিয়া ও উপ-মহাসচিব সুলতান আহমেদের সরাসরি আর্থিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে।

চেয়ারম্যান ডা. মোঃ আজিজুল ইসলামের নেতৃত্বে রেড ক্রিসেন্ট একটি নিরপেক্ষ মানবিক সংস্থা থেকে ক্রমে রাজনৈতিক পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ বঙ্গবন্ধু পরিষদ” সংশ্লিষ্ট বিতর্কিত ও অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অবৈধভাবে পদোন্নতি দিয়ে এবং পুনর্বহাল করে রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠা করেছেন।

বঙ্গবন্ধু পরিষদ এর নেতা রেজাউল করিমের পদোন্নতি আর্থিক লেনদেন: ১০ এপ্রিল ২০২৫ গভর্নিং বোর্ড সভায় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীকে উপেক্ষা করে, বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা রেজাউল করিমকে রাজনৈতিক পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অভিযোগ অনুযায়ী, এ সিদ্ধান্তে উপ-মহাসচিব সুলতান আহমেদ ও পিএস সোহাগ মিয়ার মাধ্যমে মোটা অঙ্কের ঘুষ লেনদেন হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু পরিষদ এর আরও তিনজন সদস্যের পদোন্নতি: চেয়ারম্যানের একক নির্দেশে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ চার তিনজন -সাবিনা ইয়াসমিন, সেলিম আহমেদ, এ এস এম আক্তার-কে প্রায় ১০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে পরিচালক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এতে যোগ্য ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তারা উপেক্ষিত হন।

আওয়ামী নেত্রীর স্বামী মিজানুর রহমানের বিতর্কিত পুনঃনিয়োগ: চেয়ারম্যানের একক সিদ্ধান্তে এবং বোর্ডের মত উপেক্ষা করে, আওয়ামী ঘনিষ্ঠ মোঃ মিজানুর রহমানকে বারবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি সাবেক বোর্ড সদস্য ও আওয়ামীনেত্রী রাজিয়া সুলতানা লুনার স্বামী এবং পলাতক খুনি পুলিশ কর্মকর্তা হাফিজ আক্তারের ভগ্নীপতি। তাঁর পুনঃনিয়োগের পেছনে রাজনৈতিক সংযোগ ও আর্থিক লেনদেনের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

বিতর্কিত পুনর্বহালসমূহ:

ডা. এস. এম. হুমায়ুন কবির: দুর্নীতির অভিযোগে বদলি হওয়া সত্ত্বেও ১৫ এপ্রিল ২০২৫ রক্ত কর্মসূচির পরিচালক পদে পুনর্বহাল। বয়সসীমা অতিক্রম করেও চাকরিতে যোগদান এবং আত্মীয়-স্বজনসহ শতাধিক২ অবৈধ নিয়োগ ও টেন্ডারবিহীন কোটি টাকার কেনাকাটার অভিযোগ রয়েছে।

নাজমা পারভীন: সাবেক আওয়ামী ফ্যাসিস্ট চেয়ারম্যানের বোন ও মহিলা লীগ নেত্রীকে রাজনৈতিক প্রভাবে সরাসরি পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। বর্তমান চেয়ারম্যান আজিজুল ইসলাম তাকে বোর্ডের অনুমতি ছাড়াই চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বদলি করে নিয়ে এসে সুবিধাজনক পদে পুনর্বহাল করেন।

কাজী আসাদ: সোসাইটিতে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সদস্য ও অত্যন্ত বিতর্কিত কাজী আসাদকে পুনর্বহাল করে তাঁর স্ত্রীকে ঘুষের বিনিময়ে হলি ফ্যামিলিতে নিয়োগ। এই বদলিতে সোহাগ মিয়া ও সুলতান আহমেদের ভূমিকা স্পষ্ট।

তৌহিদুর রহমান নয়ন: বঙ্গবন্ধু পরিষদের আলোচিত ক্যাডার, বিপুল অর্থের বিনিময়ে রংপুর থেকে ঢাকায় বদলি।

এসব ঘটনা চেয়ারম্যানের সরাসরি নেতৃত্বে রাজনৈতিক আনুগত্যের বিনিময়ে বদলি ও নিয়োগবাণিজ্যের সুসংগঠিত চিত্র তুলে ধরে, যা সংস্থার নিরপেক্ষতা ও মানবিক কার্যক্রমের জন্য চরম হুমকি।

জেলা শাখা পর্যায়ে কমিটি পুনর্গঠনে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব দুর্নীতির অভিযোগ

বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ৬৮টি ইউনিটের কমিটি পুনর্গঠনে চেয়ারমান মেজর জেনারেল (অব.) ডা. মো. আজিজুল ইসলাম ও পিএস সোহাগ মিয়ার বিরুদ্ধে একতরফা সিদ্ধান্ত, রাজনৈতিক আনুগত্য এবং ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এতে রেড ক্রিসেন্টের নিরপেক্ষতা ও সুশাসন চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

একতরফা নিয়োগ সুপারিশ উপেক্ষা: জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারদের প্রস্তাব উপেক্ষা করে চেয়ারম্যান তাঁর পছন্দের তালিকা চাপিয়ে দিয়েছেন। অনেক জেলায় এখনো কার্যকর কমিটি গঠন হয়নি

কমিটি গঠনে বাণিজ্য: সোহাগ মিয়া ও বোর্ড সদস্য ডা. শেখ আবু জাফরের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট গঠন করে কমিটি অনুমোদনের বিনিময়ে লক্ষ লক্ষ টাকার ঘুষ লেনদেন হয়েছে। এমনকি ডা. জাফর নিজেই তাঁর জেলায় ভাইস চেয়ারম্যান পদে নিজেকে বসিয়েছেন-যা ক্ষমতার অপব্যবহারের স্পষ্ট উদাহরণ।

অযোগ্য বিতর্কিতদের নিয়োগ:

জেলা পর্যায়ে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ভোলা ইউনিটে দুর্নীতির প্রতিবাদে নবগঠিত কমিটির কয়েকজন পদত্যাগের পরও বিতর্কিতদের বহাল রাখা।

জামালপুর ও ‘ঢাকায় রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ৬৮টি ইউনিটের কমিটি পুনর্গঠনে জুয়ার সাথে জড়িত ব্যবসায়ীদের মনোনয়ন প্রদান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকের পরিবর্তে অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগ থাকা মো. খোকনকে সদস্যপদে বসানো।

স্বচ্ছতা লঙ্ঘন ভাবমূর্তির ক্ষতি:

২০২৪ সালের ৭ নভেম্বরের মহাসচিবের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ৬৮টি ইউনিটের কমিটি পুনর্গঠনে স্বচ্ছ মনোনয়ন প্রক্রিয়া শুরু হলেও চেয়ারম্যান তা উপেক্ষা করে অর্থিক ও রূজনৈতিক স্বার্থে বিতর্কিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেন, যা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংস্থার ভাবমূর্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

সোসাইটির মেরুদন্ড হিসেবে পরিচিত যুবস্বেচ্ছাসেবকদের ওপর দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ উগ্রপন্থার পৃষ্টপোষকতা

নিরপেক্ষত, মানবিক মূল্যবোধ ও তরুণদের স্বেচ্ছাসেবী নেতৃত্বের বিকাশ-এই তিনটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির যুব কাঠামো আজ চরম সংকটে। এই সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. মোঃ আজিজুল ইসলাম, যিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই সংগঠনের মূল মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত যুব-স্বেচ্ছাসেবকদের পরিকল্পিতভাবে কোণঠাসা করে চলেছেন।

যুব কাঠামোর অব্যাহত ধ্বংসযজ্ঞ; চেয়ারম্যানের নেতৃত্বের অন্তরালে মূলত চলছে উগ্রপন্থী আনুগত্যভিত্তিক একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দুরভিসন্ধি। জাতীয় যুব কাঠামোতে হিযবুত তাহরীর সংশ্লিষ্টদের অন্তর্ভুক্তি, বিতর্কিত কমিটি গঠন এবং অভিজ্ঞ, মানবিক কাজে নিবেদিত স্বেচ্ছাসেবকদের কার্যক্রম থেকে সরে যেতে বাধ্য করার মত ঘটনাগুলো স্পষ্টতই একটি সুপরিকল্পিত অপতৎপরতার ইঙ্গিত বহন করে।

নেতৃত্বের দমননীতি একচেটিয়াত্ব: অভিযোগ রয়েছে, জেলা ও ইউনিট পর্যায়ের যুব কমিটি গঠনের সময় স্থানীয় মতামতকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে, স্বেচ্ছাচারীভাবে ‘চেয়ারম্যান-ঘনিষ্ঠ’ অনুগতদের একতরফাভাবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়া যুব কাঠামোকে বাক্তি নির্ভর ও রাজনৈতিক আনুগত্যের উপনিবেশে পরিণত করছে, যা রেড ক্রিসেন্টের দলনিরপেক্ষতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। ২০২৫ সালের ১৬ মার্চ যুব স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর হামলার ঘটনায় চেয়ারম্যানের প্রত্যক্ষ ভূমিকা এবং ঘটনার ধামাচাপা দেওয়ার প্রয়াস তাঁর দমনমূলক ও ক্ষমতার অপব্যবহারকে উন্মোচিত করে। অর্ধশতাধিক তরুণ স্বেচ্ছাসেবক আহত হয়েও বিচার পায়নি, বরং হামলাকারীরা রয়ে গেছে রক্ষিত-চেয়ারম্যানের হরছায়ায়।

উগ্রপন্থার পৃষ্ঠপোষকতাএক ভয়ানক মোড়: সবচেয়ে বিপজ্জনক ঘটনা হলো, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সক্রিয় সদস্য মো. রায়হান রহমানকে জাতীয় যুব স্বেচ্ছাসেবক আহ্বায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। এটি শুধু প্রতিষ্ঠনটির নিরাশঞ্জ নয়, বরং তরুণদের চিন্তাগত ও আদর্শিক ভবিষ্যতের জন্যও এক ভয়াবহ হুমকি। এই নিয়োগের মাধ্যমে রেড ক্রিসেন্টের নীতিগত নিরপেক্ষতা ও আন্তর্জাতিক মানবিক মানদণ্ড চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। উগ্র মতাদর্শের পৃষ্ঠপোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট কার্যত একটি বিভ্রান্তিকর, চরমপন্থী ধানধারণার প্ল্যাটফর্মে রূপ নিতে চলেছে।

নিষ্ক্রিয়তা নয়, সময় এখন প্রতিরোধের: বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রাণশক্তি হিসেবে পরিচিত যুব-স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর এই পরিকল্পিত আঘাত সোসাইটির দীর্ঘমেয়াদি মানবিক ভিত্তিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। এই প্রজন্ম হারালে হারাবে রেড ক্রিসেন্টের ভবিষ্যৎ, নেতৃত্ব হারাবে তার আত্মা।

চেয়ারম্যানের ছত্রচ্ছায়ায় রেড ক্রিসেন্টে তার পিএস সোহাগ মিয়ার জালিয়াতি, স্বজনপ্রীতি নিয়োগ বাণিজ্যের ভয়াবহ চিত্র:

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. মো. আজিজুল ইসলাম দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই শুরু করেন একের পর এক অনিয়ম ও বিতর্কিত নিয়োগ প্রক্রিয়া। এর মঞ্চে সবচেয়ে আলোচিত ও নিন্দিত ঘটনা ছিল তাঁর ব্যক্তিগত চেম্বারের সিরিয়াল ব্যবস্থাপনার কর্মচারী মো, সোহাগ মিয়াকে ‘ব্যক্তিগত সহকারী-১ (পিএস-১)’ পদে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া-যা রেড ক্রিসেন্টের নীতিমালা, অর্গানোগ্রাম, স্ট্যান্ডিং অর্ডার ও মানবসম্পদ বিধির নির্লজ্জ লঙ্ঘন।

এই নিয়োগ ছিল একটি সুপরিকল্পিত অনিয়মের প্রতীক। সোহাগ মিয়াকে নিয়োগ দিতে গিয়ে চেয়ারম্যান প্রথমেই অভিজ্ঞ ও পূর্বনিযুক্ত পিএস-কে সরিয়ে দেন। নতুন পিএস নিয়োগে ছিল না কোনো সার্কুলার, প্রতিযোগিতা কিংবা গভর্নিং বোর্ডের অনুমোদন। একই কৌশলে চেয়ারম্যান তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িচালক এনামুলকেও নিয়ম উপেক্ষন করে প্রতিষ্ঠানে ড্রাইভার পদে নিয়োগ দেন।

এখানেই শেষ নয়-অভিযোগ রয়েছে, সোহাগ মিয়া আগের চাকরি গোপন রেখে একই সময়ে দু’ টি প্রতিষ্ঠানে থেকে বেতন গ্রহণ করেছেন, যা প্রতারণা ও স্বার্থের সংঘাতের জঘন্য দৃষ্টান্ত। আরও উদ্বেগজনক, তিনি নিজেই নিজের নিয়োগপত্র ও বেতন বৃদ্ধির নথি প্রস্তুত করে চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর নিয়ে তা অনুমোদন করান, কোনোরকম প্রশাসনিক যাচাই-বাছাই বা বোর্ড মতামত ছাড়াই। এই পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন কেবল তিনজন-চেয়ারম্যান, সোহাগ মিয়া এবং তৎকালীন উপ-মহাসচিব সুলতান আহমেদ-যা পুরো নিয়োগ ব্যবস্থাকে গুরুতরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।

এই ঘটনাগুলো কেবল বেআইনি নিয়োগ নয়, বরং চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে কীভাবে একটি মানবিক প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিপ্রধান কর্তৃত্ব, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির করাল ছায়ায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে- তার একটি ভয়াবহ উদাহরণ।

সোহাগ মিয়া পিএস হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই রেড ক্রিসেন্টে চেয়ারম্যানের ‘অঘোষিত মুখপাত্র’ ও ‘নির্বাহী এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করতে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, উপ-মহাসচিব সুলতান আহমেদের সঙ্গে মিলে তিনি পদোন্নতি, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যে সরাসরি জড়িত হয়ে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির সিন্ডিকেট চালান। এছাড়াও, চেয়ারম্যানের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় সোহাগ মিয়া হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজে কোটাবাণিজ্য ও প্রকল্প তহবিল অপব্যবহারের নেপথ্য কারিগর হিসেবে অভিযুক্ত। অভিযোগ রয়েছে, দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত কোটার আসন অর্থের বিনিময়ে বিত্তশালী ছাত্রদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে-যা রেড ক্রিসেন্টের মানবিক নীতিমালা ও নৈতিকতার ভয়াবহ লঙ্ঘন।

এছাড়া, চেয়ারম্যানের পারিবারিক ড্রাইভার এনামুলকে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগ এবং পূর্বনিযুক্ত অভিজ্ঞ পিএসকে সরিয়ে চেম্বারের লোক বসানো হয়েছে। এসব ঘটনায় চেয়ারম্যানের একচ্ছত্র ক্ষমতা ও স্বজনপ্রীতির নগ্ন প্রকাশ স্পষ্ট।

চেয়ারম্যানের অদক্ষতায় আন্তর্জাতিক আস্থা সংকট: রেড ক্রিসেন্টের গ্রহণযোগ্যতা ধ্বংসের পথে:

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির বর্তমান চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ডা. মোঃ আজিজুল ইসলামের অদক্ষ নেতৃত্ব ও দুর্নীতিপরায়ণতার কারণে সংস্থাটি আজ ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক দখলদারিত্ব এবং আন্তর্জাতিক মানবিক মানদণ্ডের চরম লঙ্ঘনের মুখে পড়েছে।

চেয়ারম্যান ও তার পরিচালিত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে উঠা আরও কিছু গুরুতর অভিযোগ উপস্থাপন করা হলো: উন্নয়ন তহবিলের অপব্যবহার: রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ত্রাণ কার্যক্রম, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা অপারেশন, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল ও নার্সিং কলেজ উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে, ফলে প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও গুণগতমান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৫

ভয়ভীতি সামরিক কায়দার দমননীতি: সংস্থার ভেতরে মতপ্রকাশ, ন্যায়বিচার ও মানবিক মূল্যবোধের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভয়ভীতি, দমন ও একনায়কতান্ত্রিক শাসন, যা রেড ক্রস/রেড ক্রিসেন্ট আন্দোলনের নিরপেক্ষতার মূলনীতি পরিপন্থী।

ত্রাণ তহবিল বিতরণে পক্ষপাত: দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবর্তে রাজনৈতিকভাবে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের তালিকাভুক্ত করে ত্রাণ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। রমজান ও কোরবানির সময়েও এমন পক্ষপাতিত্ব চালানো হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ অডিট দমন: আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়ম আড়াল করতে অডিট প্রতিবেদন গোপন রাখা হয়; অভিযোগ রয়েছে যে পরিচালক (অডিট)-কে ভয়ভীতি দেখিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়।

চাকরির স্থায়ীকরণে ঘুষের প্রস্তাব: যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি আটকে রেখে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের প্রস্তাব দেওয়া হয়, যা দমনমূলক, দুর্নীতিপূর্ণ এবং প্রশাসনিকভাবে বিধিবহির্ভূত।

আন্তর্জাতিক অংশীদারদের আস্থা সংকট: উপরোক্ত সব অনিয়মের কারণে আন্তর্জাতিক দাতা ও অংশীদার সংস্থাগুলোর মধ্যে গভীর আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে এবং অনেকেই সহযোগিতা পুনর্বিবেচনার পথে এগোচ্ছে।

সর্বশেষ - রাজনীতি