নিজস্ব প্রতিবেদক :
জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী আব্দুর রহিমকে (৩২) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট।
শুক্রবার (১৭ মে) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন ডিএমপি কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার (সিটিটিসি) মো. আসাদুজ্জামান।
এর আগে বুধবার (১৫ মে) গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার দেওয়া তথ্য মতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও বিস্ফোরক জব্দ করেছে সিটিটিসি।
অভিযানে তার হেফাতজ থেকে জব্দ করা হয়েছে- একটি ৭.৬৫ বিদেশি পিস্তল, দেশীয় তৈরি বন্দুক চারটি, দেশীয় তৈরি বারুদ লোডেড গান তিনটি, দেশীয় তৈরি ওয়ান শুটার গান একটি, দেশীয় তৈরি ধারালো অস্ত্র একটি, গুলি ১৬টি, কার্তুজ ১১টি, শর্টগানের খোসা ২৪টি, বাইনোকুলার দুইটি, গ্যাস মাস্ক একটি, চার্জার লাইট একটি, রিচার্জেবল ব্যাটারি একটি, ওয়াকিটকি ও চার্জার দুইটি, এসিড সৃদশ্য তরল পদার্থ ৬ লিটার, ইলেক্ট্রিক তার ৬০ ফুট, মোবাইল সিগন্যাল বুস্টার একটি, তারসহ এন্টেনা একটি, হাতুরি একটি, করাত একটি, হেক্স ব্লেড একটি, বাল্ব চারটি, ইলেকট্রিক হোল্ডার চারটি, নীল রংয়ের প্লাস্টিকের ড্রাম দুইটি ও ত্রিপাল একটি।
সিটিটিসি জানায়, গ্রেপ্তার আব্দুর রহিম ২০১৯ সালের দিকে ‘রহিম ডাকাত’ গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়ে রামু ও নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন। সম্প্রতি তিনি জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’-কে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করতেন।
সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার (সিটিটিসি) মো. আসাদুজ্জামান জানান, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী আব্দুর রহিম গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, শারক্বীয়া সংগঠনকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের জন্য বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির গহীন বনে ড্রামের ভেতরে মাটির নিচে লুকিয়ে রেখেছিল। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি থানাধীন ছাগল খাইয়্যা এলাকার পাহাড়ের ঢালে ঘন জঙ্গলের মধ্যে মাটির নিচে রক্ষিত অবস্থায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্র-গুলিসহ বিষ্ফোরক সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়েছে।
সিটিটিসি প্রধান বলেন, আব্দুর রহিম অন্য একটি সংগঠনকে অস্ত্র সরবরাহের জন্য অস্ত্র মজুদ করছিলেন। আগে একাধিকবার অন্য জঙ্গি সংগঠনকে অস্ত্র-গোলাবারুদ সরবরাহ করেছিলেন তিনি।
তিনি আরও জানান, পার্বত্য অঞ্চলে যখন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ট্রেনিং ক্যাম্পের সন্ধান পাওয়া যায় তখন যৌথবাহীনির অভিযান শুরু হলে গ্রেপ্তার আব্দুর রহিম একাধিকবার জঙ্গি সংগঠনগুলোকে অস্ত্র সরবরাহ করেছেন। পরে আরও বেশি অস্ত্র দেওয়ার কথা ছিল। তার কিছু অংশ তিনি সংগ্রহ করেছিলেন। যৌথ বাহিনীর অভিযানের সময় তিনি এসব অস্ত্র মাটির নিচে লুকিযে রেখে সমতলে চলে আসেন।
সম্প্রতি আমরা গাজীপুরে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করি। জিজ্ঞাসাবাদে সে এসব অন্ত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। তাকে নিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ির গহীন বনে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে শারক্বীয়ার সদস্যদের ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইজ (আইইডি) তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। এতে বিভিন্ন ধরনে কেমিক্যাল লাগতো। সেই কেমিক্যালও সরবরাহের কথা ছিল। তিনি জঙ্গি সংগঠনে সরবরাহের জন্য মোবাইল নেটওয়ার্ক বুস্টার সংগ্রহ করেছিলেন। তবে কিভাবে এটি সংগ্রহ করেছেন সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
সিটিটিসি প্রধান আরও বলেন, জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার মাস্টারমাইন্ড ও সংগঠনের প্রধান শামিন মাহফুজ যখন পাহাড়ে সংগঠনের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শুরু করেন, তখন থেকে আব্দুর রহিম অস্ত্র সংগ্রহের কাজ করছিলেন। তার সঙ্গে পূর্বে গ্রেপ্তার হওয়া অস্ত্র সরবরাহকারী মো. কবির আহাম্মদ যোগাযোগ ছিল। কবির সংগঠনের জন্য কাজ করতে রহিমকে প্রস্তাব দেন। এতে রহিম তার প্রস্তাবে রাজি হন এবং অস্ত্র সরবরাহের পাশাপাশি সংগঠনের সদস্য সংগ্রহেও কাজ করতেন।
কীভাবে তিনি এসব অস্ত্র সংগ্রহ করেছেন, তার সঙ্গে আর কে জড়িত আছে এবং কোন কোন পর্যায় থেকে সে সহযোগিতায় পেয়েছে এসব জানতে রহিমের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠানো হবে।
সিটিটিসির প্রধান আরও জানান, ২০২৩ সালের ২৩ জুন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার মাস্টারমাইন্ড ও সংগঠনের প্রধান শামিন মাহফুজকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে গ্রেপ্তারের পর শারক্বীয়ার প্রশিক্ষণ, অস্ত্রগুলির উৎস, অর্থায়ন সম্পর্কে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। শামিন মাহফুজকে গ্রেপ্তার আগে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী মো. ইয়াছিন (৪০) এবং বান্দরবান থেকে অস্ত্র সরবরাহকারী মো. কবির আহাম্মদকে (৫০) ওই বছরের ৮ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সে সময় তারা জানান, কুকি চিনের পাশাপাশি স্থানীয় কবির আহাম্মদ ও আব্দুর রহিম শারক্বীয়ার সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য অর্থের বিনিময়ে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করেন।
পাহাড়ে প্রশিক্ষণ ক্যাস্পে অংশ নেওয়া কতজন পলাতক রয়েছে? সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে সিটিটিসি প্রধান বলেন, প্রশিক্ষণে অংশ নেওয় সবার তালিকা পেয়েছি। তালিকার প্রায় সবাই গ্রেপ্তার হয়েছেন। শুধু তাই নয়, যারা প্রশিক্ষণের দাওয়াত পেয়েছে তাদেরও নাম পেয়েছি। তাদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পাহাড়ে বড় আতঙ্কের নাম আইইডি, তাহলে কি গ্রেপ্তার আব্দুর রহিম এসব আইইডির সরঞ্জাম সরবরাহ করেছেন? আপনাদের কাছে কী তথ্য আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে সিটিটিসি প্রধান বলেন, এ বিষয়ে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করছি। তার কাছে যেহেতু কেমিক্যাল পাওয়া গেছে এবং প্রশিক্ষণ ক্যাম্পেও আইইডি প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়েও তথ্য পেয়েছি। আমরা এই বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক আছি। তিনি আর কোথায় কোথায় কেমিক্যাল সরবরাহ করেছেন সে বিষয়ে রিমান্ডেতে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
দেশের বাইরে অন্য কোনো সংগঠনের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে কিনা? জানতে চাইলে মো. আসাদুজ্জামান বলেন, দেশে বা দেশের বাইয়ে তার কোনো নেটওয়ার্ক আছে কিনা তা জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
বর্তমানে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া সংগঠনের নেতৃত্ব কে দিচ্ছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা মনে করি সংগঠনের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কেউ নেই। এই সংগঠনের সব শীর্ষ নেতাকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। নতুন করে সংগঠিত হওয়ার মতো কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।
গত মার্চ মাসে আইএসআইএস এর প্রধান হারিজ ফারুকী ভারতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তারা বলছেন- তিনি (হারিজ ফারুকী) বাংলাদেশে ছিলেন? তাদের সঙ্গে রহিমের কোনো যোগাযোগ আছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়টি আমি আগেই অস্বীকার করেছি। কারণ বাংলাদোশে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আন্তর্জাতিক জঙ্গী অবস্থান করবে। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংঘটের কারও অবস্থানের প্রশ্নই আসে না।